আলাউদ্দিনের চেরাগ
– হুমায়ুন আহমেদ

নান্দিনা পাইলট হাইস্কুলের অঙ্ক শিক্ষক নিশানাথ বাবু কিছুদিন হলো রিটায়ার করেছেন। আরো বছরখানেক চাকরি করতে পারতেন, কিন্তু করলেন না। কারণ দুটো চোখেই ছানি পড়েছে। পরিষ্কার কিছু দেখেন না। ব্ল্যাক বোর্ডে নিজের লেখা নিজেই পড়তে পারেন না।

নিশানাথবাবুর ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একটা মেয়ে ছিল। খুব ছোটবেলায় টাইফয়েডে মারা গেছে। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন গত বছর। এখন তিনি একা-একা থাকেন। তাঁর বাসা নান্দিনা বাজারের কাছে। পুরান আমলের দু-কামরার একটা পাকা দালানে তিনি থাকেন। কামরা দুটির একটি পুরান লক্কর জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা। তাঁর নিজের জিনিস নয়। বাড়িওয়ালার জিনিস। ভাঙা খাট, ভাঙা চেয়ার, পেতলের তলা নেই কিছু ডেগচি, বাসন-কোসন। বাড়িওয়ালা নিশানাথ বাবুকে প্রায়ই বলেন–এইসব জঞ্জাল দূর করে ঘরটা আপনাকে পরিষ্কার করে দেব। শেষ পর্যন্ত করে না। তাতে নিশানাথ বাবুর খুব একটা অসুবিধাও হয় না। পাশে একটা হোটেলে তিনি খাওয়া-দাওয়া সারেন। বিকেলে নদীর ধারে একটু হাঁটতে যান। সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকেন। তার একটা কোরোসিনের স্টোভ আছে। রাতের বেলা চা খেতে ইচ্ছা হলে স্টোভ জ্বালিয়ে নিজেই চা বানান।

জীবনটা তার বেশ কষ্টেই যাচ্ছে। তবে তা নিয়ে নিশানাথ বাবু মন খারাপ করেন না। মনে মনে বলেন, আর অল্প কটা দিনই তো বাঁচব, একটু না হয় কষ্ট করলাম। আমার চেয়ে বেশি কষ্টে কত মানুষ আছে। আমার আবার এমন কী কষ্ট।

একদিন কার্তিক মাসের সন্ধ্যাবেলায় নিশানাথ বাবু তার স্বভাবমতো সকাল সকাল রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন। নদীর পাশের বাঁধের উপর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটলেন। চোখে কম দেখলেও অসুবিধা হয় না, কারণ গত কুড়ি বছর ধরে এই পথে তিনি হাঁটাহাঁটি করছেন।

আজ অবশ্যি একটু অসুবিধা হলো। তার চটির একটা পেরেক উঁচু হয়ে গেছে। পায়ে লাগছে। হাঁটতে পারছেন না। তিনি সকাল সকাল বাড়ি ফিরলেন। তার শরীরটাও আজ খারাপ। চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে। বাঁ চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে।

বাড়ি ফিরে তিনি খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলেন। রাত নটার দিকে তিনি ঘুমুতে যান। রাত নটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। সময় কাটানোটাই তার এখন সমস্যা। কিছু-একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে হতো। কিন্তু হাতে কোনো কাজ নেই। বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। চটির উঁচু হয়ে থাকা পেরেকটা ঠিক করলে কেমন হয়? কিছুটা সময় তো কাটে। তিনি চটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাতুড়ি জাতীয় কিছু খুঁজে পেলেন না। জঞ্জাল রাখার ঘরটিতে উঁকি দিলেন। রাজ্যের জিনিস সেখানে, কিন্তু হাতুড়ি বা তার কাছাকাছি কিছু নেই। মন খারাপ করে বের হয়ে আসছিলেন, হঠাৎ দেখলেন ঝুড়ির ভেতর একগাদা জিনিসের মধ্যে লম্বাটে ধরনের কী একটা যেন দেখা যাচ্ছে। তিনি জিনিসটা হাতে নিয়ে জুতার পেরেকে বাড়ি দিতেই অদ্ভুত কাণ্ড হলো। কালো ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি হয়ে গেল।

তিনি ভাবলেন চোখের গণ্ডগোল। চোখ দুটো বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে। কিন্তু না, চোখের গণ্ডগোল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ধোয়া কেটে গেল। নিশানাথ বাবু অবাক হয়ে শুনলেন, মেঘগর্জনের মতো শব্দে কে যেন বলছে, আপনার দাস আপনার সামনে উপস্থিত। হুকুম করুন। এক্ষুনি তালিম হবে।

নিশানাথ বাবু কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে কথা বলে?

: জনাব আমি। আপনার ডান দিকে বসে আছি। ডান দিকে ফিরলেই আমাকে দেখবেন।

নিশানাথ বাবু ডান দিকে ফিরতেই তার গায়ে কাঁটা দিল। পাহাড়ের মতো একটা কী যেন বসে আছে। মাথা প্রায় ঘরের ছাদে গিয়ে লেগেছে। নিশ্চয়ই চোখের ভুল।

নিশানাথ বাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, বাবা তুমি কে? চিনতে পারলাম না তো।

: আমি হচ্ছি আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য। আপনি যে জিনিসটি হাতে নিয়ে বসে আছেন এটাই হচ্ছে সেই বিখ্যাত আলাউদ্দিনের চেরাগ।

: বলো কি!

: সত্যি কথাই বলছি জনাব। দীর্ঘদিন এখানে-ওখানে পড়ে ছিল। কেউ ব্যবহার জানে না বলে ব্যবহার হয় নি। পাঁচ হাজার বছর পর আপনি প্রথম ব্যবহার করলেন। এখন হুকুম করুন।

: কী হুকুম করব?

: আপনি যা চান বলুন, এক্ষুনি নিয়ে আসব। কোন জিনিসটি আপনার প্রয়োজন?

: আমার তো কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই।

চেরাগের দৈত্য চোখ বড় বড় করে অনেকক্ষণ নিশানাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, জনাব, আপনি কি আমায় ভয় পাচ্ছেন?

: প্রথমে পেয়েছিলাম, এখন পাচ্ছি না। তোমার মাথায় ঐ দুটো কী? শিং নাকি?

: জি, শিং।

: বিশ্রী দেখাচ্ছে।

চেরাগের দৈত্য মনে হলো একটু বেজার হয়েছে। মাথার লম্বা চুল দিয়ে সে শিং দুটো ঢেকে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, এখন বলুন কী চান?