উনিশ শ’ একাত্তর
– ইমদাদুল হক মিলন

একদিন দুপুর বেলা দীনুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। একাত্তর সালের কথা। বর্ষাকাল ছিল সেদিন, টানা দশ দিন পর দীনুদের ছোট্ট মফস্বল শহরে দুপুরের দিকে রোদ উঠেছে। এক দিন ছিল বৃষ্টি। ঘোর বৃষ্টি। সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। আকাশ ছিল পোড়া মাটির চুলোর মতো। থেকে থেকে মেঘ ডেকেছে, বিদ্যুৎ চমকেছে। আর বৃষ্টি। কেমন বৃষ্টি। শহরের চারদিকে ছিল বর্ষার জল। জলের উপর মাইলকে মাইল ভেসে ছিল আমন ধান। ধানে তখন থোড় আসার সময়। বৃষ্টি ছিল, বাতাস ছিল না বলে বৃষ্টির তলায় ধানী মাঠগুলো ছিল স্বপ্নের মতো স্থির। সুবলদের বাড়িটা শূন্য পড়ে আছে অনেকদিন। বর্ষার মুখে সুবলেরা বাড়ি ছেড়ে গেল। যাওয়ার দিন সকালবেলা সুবলের বুড়ি দিদিমা দীনুকে ডেকে বললেন, ‘আমরা চলে যাচ্ছি দীনু’। তারপর আঁচলে চোখ মুছলেন।

দীনু কিছু বুঝতে পারে না। দিদিমার চোখে জল দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তারপর টের পায় নিজের চোখও জলে ভরে আসছে তার। দীনু ছেলেটা এই রকম। কারও চোখের জল সইতে পারে না। জন্মের পর সে দেখেছে এই মফস্বল শহর, এই সব মানুষ জন। জগৎ সংসারে তার আপন কেউ নেই বলে এই শহরের সবাই তার বড় আপন। কাউকে দীনু ডাকে বাবা, কাউকে মা, ভাইবোন, দিদিমা, জ্যাঠা, চাচা, মামা, খালা, পিসি-আত্মীয়ের অভাব নেই দীনুর। আর নিজের কোনো বাড়ি ঘর নেই বলে এই শহরের সবগুলো বাড়িঘরই দীনুর নিজের। যখন সে ইচ্ছে বাড়ি যায়। খিদে থাকলে সোজা গিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। ঘুম পেলে যে কোনো বিছানায় ফাঁক ফোঁকর দিয়ে গুটিশুটি শুয়ে পড়ে। দীনুকে কেউ কখনো ফেরায় না।

দীনুর বয়স দশ বছর। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কখনো ওর সঙ্গে রাগ করতে পারে না। দশ বছর বয়সে দীনুও যেন কেমন করে কথাটা জেনে গেছে।

কিন্তু একটা কথাই দীনুর জানা হয়নি- দীনু হিন্দু না মুসলমান! কেমন করে যে এই শহরে এসেছিল, কার কোলে কেউ তা জানে না। যদিও এ নিয়ে দীনুর কোনো দুঃখ নেই। সুখ আছে। দশ বছরের জীবনেই দীনু জেনে গেছে মানুষের মধ্যে অনেক ভাগ। সে কোন ভাগে?

দীনু জানে না। সুখটা এই। অবাধে সে হিন্দু বাড়ি যায়। মাসি পিসি ডাকে। পেটপুরে খায়, ঘুমায়। যায় মুসলমান বাড়ি। খালা ফুফু ডাকে। পেটপুরে খায় ঘুমায়। দীনুর কোনো দুঃখ নেই।

তো সুবলের দিদিমা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘দীনুরে আমরা কলকাতা যাচ্ছি।’

‘কোথায় দিদিমা’?

‘কলকাতা।’

কলকাতা কোথায়, দীনু জানে না। তার মনে হয় এই শহরের আশেপাশেই হবে কলকাতা, দিদিমারা বোধ হয় আত্মীয়- বাড়ি যাচ্ছে বেড়াতে। দু-পাঁচ দিন পর ফিরে আসবে।

কিন্তু দিদিমা তাহলে কাঁদে কেন? দীনু তখন সারা বাড়ির লোকজনের মুখ দেখে। কেমন থমথমে দুঃখী মুখ সবার। আর কত যে বোচকা বুচকি। খাট-পালঙ্ক আর ভারি জিনিসপত্র ছাড়া সবই নিয়ে যাচ্ছে সুবলরা। আত্মীয় বাড়ি গেলে কেউ কি অতো জিনিসপত্র নিয়ে যায়?

দীনুর মাথার ভেতর বড় রকমের একটা গিট লেগে যায়। গিট খুলতে দীনু যায় সুবলের কাছে।

সুবল দীনুর বয়সী। হলে হবে কী, সুবলটা বড় বুদ্ধিমান । স্কুলে পড়ে তো।

‘জানিস না দেশে গন্ডগোল লেগেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কত মিলিটারি এসেছে। মিলিটারিরা সব মানুষ মেরে ফেলবে। ইয়া বড় বড় বন্দুক আছে।’

শুনে দীনু খুব ভয় পেয়ে যায়। ‘হায় হায়, তাহলে !’

‘তাহলে আর কি! আমরা তো এজন্যই চলে যাচ্ছি।’

তখন দীনু একটা আবদার করে বসে। ‘সুবল আমাকে নিবি?’

‘যাঃ, তোকে কোথায় নেব।’

একথা শুনে সুবলের দিদিমা এগিয়ে আসেন। তারপর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দীনুর মাথায় হাত রাখেন। ‘দীনু দাদারে, মন খারাপ করিস নে। ওখানে আমাদেরই কোনো ঠাঁই ঠিকানা নেই। থাকলে তোকে নিয়ে যেতাম।’

তারপর আবার আঁচলে চোখ ঢাকেন। দেখে দীনু এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলে।

দিদিমা বললেন, ‘আমাদের এই বাড়িটা তোকে দিয়ে গেলাম। তোর তো কোথাও থাকার জায়গা নেই। এখানে থাকিস। একা থাকতে ভয় লাগলে কাউকে নিয়ে থাকিস।

ঘরে চাল-ডাল সব আছে। তোর ছমাস চলবে। আর শোন দাদু, তোর ভয় নেই। তুই খুব ভালো ছেলে। তোকে পাকিস্তানি সেনারা কিছু করবে না। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ফিরে আসব।’

‘দেশ স্বাধীন মানে?’

এত দুঃখের মধ্যেও সুবলের দিদিমা হেসে ফেলেন। ‘এই দেশটা পূর্ব বাংলা, আর পূর্ব বাংলা থাকবে না। হবে বাংলাদেশ।’

দীনু হয়তো আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু তার আগে খালপাড়ে বিরাট ছইওয়ালা নৌকা এসে ভিড়ল। বোচকা-বুচকি নিয়ে সুবলেরা সব নৌকায় গিয়ে উঠল। দীনু গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল খালপাড়ে। তারপর যতক্ষণ সুবলদের নৌকা দেখা যায়, ততক্ষণ কতবার যে চোখের জল মুছল, গোণাগুণতি নেই।

সেই দিনটা বড় খারাপ কেটেছে দীনুর। সারাদিন কিছু খায়নি। সুবলদের বাড়ির তিনটে ঘরের চাবিই দীনুকে দিয়ে গিয়েছিলেন সুবলের দিদিমা। কিন্তু দীনু শুধু খুলেছিল বাংলাঘরের তালা।

সুবলদের বাংলাঘরে পুরনো কালের বিশাল একটা চৌকি পাতা। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে। সেই চৌকিতে সারাদিন শুয়ে থেকেছে দীনু। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখেছে। সুবলদের কথা ভেবেছে, আর মিলিটারিদের কথা। মিলিটারিরা সত্যি কী সব লোকজন মেরে ফেলবে তাহলে?

এত ভাবতে ভাবতে দীনু ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দীনু খুব ভয় পেয়ে গেল। প্রথমে খানিকক্ষণ সে বুঝতে পারে না, কোথায় শুয়ে আছে। যখন বুঝতে পারল সুবলদের বাংলাঘরে-ভয়টা শুরু হলো তখুনি।