একসূত্রে
– শওকত ওসমান

বিকেল থেকে আকাশে মেঘ জমেছিল।

এ জনপদের সবাই বেলাবেলি মাঠ থেকে ফিরে এসেছে। গরু ছাগল গোয়ালে বাঁধা। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বইছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝড় শুরু হতে পারে।

বহু লোকই জমায়েত হয়েছে খাঁ-বাড়ির বিরাট দহজিলে। অবসর কাটানোর এমন সুযোগ রোজ রোজ পাওয়া যায় না। তাই কেউ তামাক খাচ্ছিল, কেউ গল্পগুজবে রত। কয়েকজন শণ দিয়ে দড়ি তৈরি করছিল। আরশাদ খাঁ প্রথমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জোরে কেশে নিলেন। কলগুঞ্জন একটু স্তিমিত হল। কারণ, এ গ্রামের সবাই জানে আরশাদ খাঁ। এবার কিছু বলবেন। গ্রামের তিনি মুরুব্বি। বয়স ষাটের বেশি। দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু দেহটি এখনও মজবুত।

– অ করিম

আরশাদ খাঁ সম্মোধন করলেন।

– জি

– ইন্সপেক্টর সাহেব গ্যাছে গা?

করিম আর একজনের সঙ্গে গল্প করছিল। হঠাৎ বাধা পড়ায় বিরক্ত হল, তাই অবহেলা-মিশ্রিত স্বরেই জবাব দিল ‘গ্যাছে গা।

– কী কইলেন তিনি ?

– কী আর কইব। কয়, আপনারা সমবায় সমিতি বানান। ফসলের ভালো দাম পাইবেন, কর্জ পাইবেন। মহাজনের কাছে জমি-জিরাত বন্ধক দেওন লাগব না। এইসব হাবিজাবি কথা।

– হুঁ, তুই কিছু কইলি ?

কী আর কইতাম চাচা। এই কথা কতই হুনছি। আপনেও হুনছেন। আমরা গা পাতলাম না। চইল্যা গ্যাছে ইন্সপেক্টর সাব।

– যাক গিয়া।

তারপরই আরশাদ খাঁ আকাশের দিকে চাইলেন। তার মুখ দিয়ে অজান্তে বের হল, ‘করিম, জোর তুফান আইতে পারে।’

একথায় করিমের মুখে শঙ্কার ছায়া পড়ে। অন্যেরা খোশগল্পে মশগুল। তারা কিছুই শুনল না।

আরশাদ খাঁর আশঙ্কাই সত্য। হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধ হল সমস্ত পৃথিবী। জোরে তুফান শুরু হবে—এ তারই পূর্বাভাস।

আরশাদ খাঁর উপদেশমতো তাই যে-যার বাড়ির দিকে ছুটল। দহলিজ আবার শূন্য।

একটু পরে শুরু হল ঝড়। সমস্ত সৃষ্টি যেন উলটপালট হবার উপক্রম। শনশন্ বাতাস গাছপালার ওপরে, টিনের ঘরে, খড়ো চালে আছাড় খেয়ে পড়তে লাগল। শতসহস্র দৈত্য যেন নির্মম আক্রোশে সব চুরমার করে অগ্রসর হচ্ছে। ক্রোধে বিকশিত দৈত্যকুলের দন্তপাটিরূপ বিদ্যুৎ আকাশের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত খেলে যাচ্ছে।

সমস্ত গ্রামবাসী ঘরের কোণে আশ্রয় নিয়েছে।

দোয়া-দরুদ পড়ছে বর্ষীয়ানরা।

কিন্তু ঝড় আর শান্ত হতে চায় না। ইসরাফিলের শিঙার আওয়াজে যেন পৃথিবী দীৰ্ণবিদীর্ণ হচ্ছে। ওদিকে কুটিল রাতের থাবার নিচে সমস্ত গ্রাম মুহ্যমান।

সমস্ত রাত এ প্রলয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল। পরদিন গ্রাম আর চেনা যায় না। লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি, গোটা এলাকার জীবন।

দেখা গেল, অধিকাংশ ঘরের চাল নেই। গ্রামের প্রায় সবাই দরিদ্র। তাদের খড়ো ঘর, ঝড়ের দাপটে সেসব এদিক ওদিক উড়ে গিয়েছে।

ঘরে ঘরে হাহাকার। ঝড় থেমেছে। কিন্তু আকাশে তখনও জমাট মেঘ। রাতে তেমন বৃষ্টি ছিল না। কোনোরকমে বেড়া কি দেওয়ালের পাশে মানুষ মাথা খুঁজেছে। কিন্তু জোরে বৃষ্টি নামলে কী হবে ? দুর্দশার আশঙ্কায় সবাই শিউরে উঠল।

খাঁ-বাড়ির দহলিজে চাল নেই। পঞ্চাশ গজ দূরে একটি বাঁশবনের পাশে পড়ে রয়েছে।

তবুও এ জায়গায় গ্রামের বহু লোক জড়ো হয়েছে।

এখন কী করা যায় সবার মুখেই এ প্রশ্ন। গ্রামে জনমজুর পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেই বা কী। প্রত্যেকটি কাজ অনড়। দু-চারজনের পক্ষে সম্পাদন একেবারেই অসম্ভব।

সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। কয়েকজনের তো হাউমাউ কান্না।

আরশাদ খাঁ এই ভিড়ে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। চিন্তামগ্ন, নিস্তদ্ধ। হঠাৎ তিনি হাত তুলতে অন্যান্যদের কথাবার্তা থেমে গেল।

আরশাদ খাঁ সম্বোধন করে বললেন, ‘ভাইসব মসিবতে কানলে হয় না। বুকে জোর করা লাগে। আমি যা কই শোন’।

সবাই নিমগ্ন চিত্তে বৃদ্ধের উপদেশ শোনে। সবারই দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ।

সংক্ষেপে তাঁর পরামর্শ এরকম : দলবদ্ধভাবে এবং পালাক্রমে তারা বিভিন্ন ঘরের চাল মেরামত শুরু করবে। প্রথমে বড় বড় কয়েকটি ঘর, যেন বৃষ্টি হলে অন্য গৃহহীনেরা আশ্রয় নিতে পারে। তারপর অন্যান্য ঘর। গ্রামের ছয় শ চাল উড়ে গেছে। কিন্তু জোয়ান লোক আছে এক হাজার। তারা একত্রে কাজ করলে কয়দিন আর লাগবে উঠাতে ?

কিছুক্ষণ আগে যারা হাউমাউ কান্না জুড়েছিল তারা পর্যন্ত সানন্দে অগ্রসর হল।

শুরু হল গ্রামে দলবদ্ধভাবে চাল মেরামত। আজ এ-পাড়া, কাল ও-পাড়া।

সবাই কাজের নেশায় মাতল। ছোটখাটো সাহায্যের জন্য অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা ভিড় করতে লাগল। তাদের কাছে ঝড়ের পর যেন নতুন তামাশার আবির্ভাব ঘটেছে। বিপদের মোকাবিলায় সবার বুকে কত হিম্মত সঞ্চিত ছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়।

কয়েকদিন পর।

আর মাত্র পাঁচ-ছ’টি ঘরের চাল ওঠানো বাকি। সারাদিন মেহনত শেষে সবাই খাঁ-বাড়ির দহলিজে জমায়েত হয়েছিল। উদ্দেশ্য অবসর উপভোগ, যুক্তি-পরামর্শ, কাজের হিসাব গ্রহণ ইত্যাদি। চারদিকে গোধূলির আবছা অন্ধকার, সন্ধ্যা আসন্ন। দহলিজে তখনও কেরোসিনের ডিবা জ্বালানো হয়নি। প্রাঙ্গণে একজন আগন্তুক উপস্থিত হলেন। এ মানুষটির অবয়ব শুধু দেখা যায়। সুতরাং চেনা কষ্টকর।

সালাম ইত্যাদির পর আগন্তুকের মুখে প্রথম প্রশ্ন : ‘আরশাদ খাঁ সাহেব কে ?’

– আমি।

আরশাদ খাঁ দাওয়ার ধারে বসেছিলেন, জবাব দিলেন। আগন্তুক খাঁ সাহেবের দিকে অগ্রসর হন। তারপর করমর্দন  করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি একটি সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছেন।’

– আমি ?

– হ্যাঁ।।

ততক্ষণে এক জন ডিবা জ্বালিয়ে এনেছে। সবার মুখে ফিসফিস শব্দ : কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর, কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর।

স্তম্ভিত আরশাদ খাঁ। মনে তার অসোয়াস্তি। তিনি বলেন, ‘আমি সমবায় সমিতি গড়েছি ?’

– হ্যাঁ।

– ক্যানে ইন্সপেক্টর সাব ?

– আপনি গড়েছেন। প্রত্যেকের কাজ সবাই মিলে করা এই তো সমবায়। আপনি যে কাজ করলেন এর আমরা কী নাম দিতাম জানেন ?

– কী ?

– সমবায় গৃহ নির্মাণ ও সংস্কার সমিতি।

– সাঁচ কইলেন, হুজুর ?

– হ্যাঁ। ঠিক এরকম সমবায় ফসল বিক্রয় সমিতি, সমবায় ঋণদান সমিতি হতে পারে।

দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে আরশাদ খাঁ বললেন, ‘ত আগে কইলেন না ক্যা? এই সব ভাত্তিরিত (ভ্রাতৃত্ব) মইততিরি (মৈত্রী)—বড় বড় কথা কী আমরা বুঝি ? সেইদিন কী কইছিলেন ?

– সব বুঝবেন। কিন্তু আজ আমি আসি। অনেক দূরে বাসা। আজ এ-পথে আসতে আপনাদের কথা শুনলাম, কাল আসব।

– আইসেন কিন্তু, হুজুর। অহন বুঝতাছি, তুফান খুব ছবক দিয়া গেছে গা।

– নিশ্চয়ই আসব।

আগন্তুক বিদায় নিল। এখানে কিন্তু কলগুঞ্জন আর থামে না। রাত গড়িয়ে যায়।

নানা আলোচনার পর আবার হঠাৎ শুন্ধতা আসে। তারই মধ্যে করিম বলল, ‘চাচা। আসমানে মেঘ জমছে। ফের যদি তুফান আহে …’

আইতে দাও। তুফানেরে আর ডরাই না। জবাব দিল আরশাদ খাঁ। কয়েকজন একত্রে চিৎকার দিয়ে উঠল – ‘আহুক তুফান ! তুফানেরে আর ডরাই না।’