কতটা জমি দরকার
– লিও টলস্টয়

এক

ছােট বােনের গ্রামের বাড়িতে শহর থেকে বেড়াতে এসেছে বড়বােন। বড়বােনের বিয়ে হয়েছে শহরে এক সওদাগরের সঙ্গে, আর ছােট বােনের হয়েছে গ্রামের এক কৃষকের সঙ্গে। দুজনে চা খেতে-খেতে গল্প করছিল। বড়বােন শহুরে জীবনের সুখ-সুবিধের কথা বলছিল ; সেখানে তাদের জীবন-যাপন কত আরাম-আয়েশের, ছেলেমেয়েদের নিত্যনতুন কত জামা কাপড় পরাতে পারে, কত রকমের মজার মজার খাবার খায়, স্কেট করে, যখন যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায়, থিয়েটারে যায়।…

বড়বােনের শহুরে আদিখ্যেতায় ছােটবােন কিন্তু ভারি বিরক্ত হল। সেও তাই শহুরে জীবনযাত্রার নিন্দে করে নিজের গ্রাম্যজীবনের খুব খানিকটা প্রশংসা করে ফেলল।

সে বলল, “দেখ, যাই বলাে না কেন, আমি কিন্তু কিছুতেই তােমার মতাে হতে চাই না। অবশ্য তােমার এসব কথা আমি স্বীকার করি যে আমাদের চাষাভুষা জীবন নিতান্ত শাদাসিধে, এখানে তেমন কোনাে রং-তামাশা কিা উত্তেজনা নেই। কিন্তু তােমাদের জীবনটাকে আরেকটু খুঁটিয়ে দেখ দেখি। তােমরা ভালাে খাও, ভালাে পৱাে, আমােদ-প্রমােদে পড়ে থাকো বটে, কিন্তু তােমাদের ভবিষৎটা কী বলতে পারাে? ব্যবসা বাণিজ্য করে তােমরা হয় খুব বড়লােক হবে নইলে পথের ফকির হয়ে ঘুরে বেড়াবে। একটা প্রবাদ আছে না—লাভ-ক্ষতি দুই ভাই। আজ যারা ধনী, পথের ভিখারি হতে তাদের কতক্ষণ ? তার চেয়ে আমরা বরং বেশ আছি। চাষীদের একগাদা টাকা কোনােদিন হয় না হয়তাে, কিন্তু খাওয়া-পরার ভাবনাও তাদের করতে হয় না। কেননা খাওয়ার মতাে প্রচুর খাদ্য তাদের সবসময়ই থাকে।

ছােটবােনের কথা শুনে হেসে উঠল বড়বােন। সঙ্গে সঙ্গে বলল : প্রচুর খাদ্য না ছাই! কতকগুলাে শুয়াের আর গরুর বাচ্চা ছাড়া তােমাদের আর আছেটা কী শুনি? না আছে। ভালাে পােশাক-আশাক, না আছে ভালাে একটা সঙ্গীসাথী, তার আবার প্রচুর! তােমাদের চাষা স্বামীরা যতই খাটুক না কেন, তােমরা আজ যেমন আছ মাটির ঘরে, মরবেও তেমনি সেখানেই। তােমার ছেলেমেয়েদের অবস্থাও ওরকম থাকবে।”

ছােটবােন বলল, “বেশ তাে, তাতে হয়েছে কী? আমাদের খুব খাটতে হয় বটে, তবে আমাদের সে খাটনি নিজেদের জমিতেই। অন্যের কাছে আমাদের মাথা নােয়াতে হয় না। আর তােমরা শহুরেরা—একটা বন্দি আবহাওয়ার মধ্যে তােমাদের জীবন কাটে। আজ তুমি ভালাে আছ, হয়তাে কালই তােমার ওপর শনির দৃষ্টি পড়ল, আর তােমার স্বামী ঘর-সংসার ভুলে জুয়া-মদে সবকিছু শিকেয় তুলল। কেমন, শহরে এসবই তাে হচ্ছে অহরহ।”

ছােটবােনের স্বামী পাখম স্টোভের পাশে বসে দুইবােনের সব কথাই শুনছিল।

সে বলে উঠল, একেবার খাটি কথা। জমিতে ফসল ফলাতে সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাদের মতাে চাষাভুষা লােকদের এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে ওসব কুচিন্তা মগজে ঢুকবার সময় পায় না। তবে বড় একটা অভাব আমার আছে, যথেষ্ট জমি নেই আমার। যদি আরেকটু জমি পাই তাহলে স্বয়ং শয়তানকেও আমি ভয় পাই না।

চা খাওয়া শেষ করে দুবােন আরাে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল জামা কাপড় নিয়ে, তারপর চায়ের কাপগুলাে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে গেল শুতে।

এদিকে হয়েছে কী, স্টোভের পেছনে শয়তান কিন্তু সারাক্ষণ ঘাপটি মেরে বসেছিল। শুনছিল সব কথা। চাষীর বৌ-এর কথায় তার স্বামী যখন গর্ব করে বলল যে একবার জমি পেলে স্বয়ং শয়তানও তা কেড়ে নিতে পারবে না, শুনে শয়তান খুশিতে নেচে উঠল।

মনেমনে সে ভাবল : চমৎকার, এবার তােমাকে নিয়েই একটা খেলা খেলব। আগে তােমাকে অনেক জমি দেব—আর কেড়ে নেব তারপর।