দুরন্ত পথিক
– কাজী নজরুল ইসলাম
সে চলিতেছিল দুর্গম কাঁটাভরা পথ দিয়া। পথ চলিতে চলিতে সে একবার পিছনে ফিরিয়া দেখিল, লক্ষ আঁখির অনিমিখ দৃষ্টি তাহার দিকে চাহিয়া আছে। সে দৃষ্টিতে আশা-উন্মাদনার যে ভাস্বর জ্যোতি ঠিকরাইয়া পড়িতেছিল, তাহাই ঐ দুরন্ত পথিকের বক্ষ এক মাদকতাভরা গৌরবে ভরপুর করিয়া দিল। সে প্রাণভরা তৃপ্তির হাসি হাসিয়া বলিল- ‘হাঁ ভাই! তোমাদের এমন শক্তিভরা দৃষ্টি পেলে কোথায়?’ অযুত আঁখির নিযুত দীপ্ত চাউনি বলিয়া উঠিল- ‘ওগো সাহসী পথিক, এ দৃষ্টি পেয়েছি তোমারই ওই চলার পথ চেয়ে।’ উহারই মধ্যে এক-রেখা ম্লানিমার মতো সে কাহার স্নেহ-করুণ চাহনি বাণীতে ফুটিয়া উঠিল ‘হায়, এ দুর্গম পথে তরুণ পথিকের মৃত্যু অনিবার্য!’ অমনি লক্ষ কষ্ঠে লক্ষ দুংকার গর্জন করিয়া উঠিল- ‘চোপরাও ভীরু, এইতো মানবাত্মার সত্য শাশ্বত পথ।’ একলা পথিক দু চোখ পুরিয়া এই কল্যাণ-দৃষ্টির শক্তি-অমিয় পান করিয়া লইল। তাহার সুপ্ত যতকিছু অন্তরের সত্য, এক অঙ্গুলি-পরশে সারা বীণায় ঝঞার মতো সাগ্রহ সাড়া দিয়া উঠিল- ‘আগে চল!’ বনের সবুজ তাহার অবুঝ তারুণ্য দিয়া পথিকের প্রাণ ভরিয়া দিয়া বলিল- ‘এই তোমার যৌবনের রাজটিকা পরিয়ে দিলাম; তমি চির-যৌবনময় চির-অমর হলে!’ পথের আকাশ অবনত হইয়া তাহার শির চুম্বন করিয়া গেল। দুরের দিগ্বলয় তাহাকে মুক্তির সীমারেখার আবছায়া দেখাইতে লাগিল। স্বাধীন দেশের তোরণদ্বার পারাইয়া মুক্তি-বাশির অগ্নিসুর হরিণের মতো তাহাকে মুগ্ধ মাতাল করিয়া ডাক দিতেছিল। বাঁশির টানে মুক্তির দিগ্বলয় লক্ষ করিয়া সে ছুটিতে লাগিল। -ওগো কোথায় তোমার সিংহদ্বার? দ্বার খোল, দ্বার খোল- আলো দেখাও, পথ দেখাও! ….. মুক্ত বিশ্বের কল্যাণমন্ত্র তাহাকে ঘিরিয়া বলিল ‘এখন অনেক দেরি, পথ চল!’ পথিক চমকিয়া উঠিয়া বলিল- ওগো আমি যে তোমাকে চাই!’ সে অচিন সাথী বলিয়া উঠিল ‘আমাকে পেতে হলে ঐ সামনের বুলন্দ দরওয়াজা পার হতে হয়!’ দুরন্ত পথিক তাহার চলার দুর্বার বেগের গতি আনিয়া বলিল, ‘হাঁ ভাই, তাই আমার লক্ষ্য।’ অনেক দুরে বনের ফাঁকে মুক্ত গগন একবার চমকাইয়া গেল। পিছন হইতে নিযুত তরুণ কণ্ঠের বিপুল বাণী শোর করিয়া উঠিল- ‘আমাদেরও লক্ষ্য ঐ, চল ভাই, আগে চল। তোমারই পায়ে চলার পথ ধরে আমরা চলেছি।’ পথিক বুকভরা গৌরবের তৃপ্তি তাহার কণ্ঠে ফুটাইয়া হাঁকিয়া উঠিল- ‘এ পথে যে মরণের ভয় আছে।’ বিক্ষুব্ধ তরুণ কষ্ঠে প্রদীপ্ত বাণী বাজিয়া উঠিল- ‘কুছ পরওয়া নেই। ও তো মরণ নয়, জীবনের আরম্ভ।’
অনেক পিছনে পাঁজরভাঙা বৃদ্ধেরা ভয়ে কাঁপিয়া মরিতেছিল। তাহাদের স্কন্ধদেশে চড়িয়া একজন মুখ ভ্যাংচাইয়া বলিতেছিল- ‘এই দেখ মরণ।’ একটু দূরে কয়লার ধুয়া ভরা আগুন জ্বালাইয়া বৃদ্ধদের দৃষ্টিহীন চক্ষু প্রতারিত করার চেষ্টা হইতেছিল। হাসি চাপিতে চাপিতে একজন ইহাদিগকে ঐ পুতি-ধূমময় আগুনের দিকে খেদাইয়া লইয়া যাইতে যাইতে বলিতেছিল- ‘ঐ তো সামনে তোমাদের নির্বাণকুণ্ড; এ বৃদ্ধ বয়সে কেন বন্ধুর পথে ছুটতে গিয়ে প্রাণ হারাবে? ওই দুরন্ত পথিকদল মরল বলে!’ বৃদ্ধের দল দুই হাত উপরে উঠাইয়া বলিল- ‘হ হুযুর, আলবত!’ তাহাদের আশেপাশে কাহার দুষ্টকণ্ঠ বারেবারে সতর্ক করিতেছিল- ‘ওরে ভিক্ষুকের দল, ভিক্ষায়ং নৈব চ নৈব চ! তোদের এরা ঐ নির্বাণকুণ্ডে পুড়িয়ে তিল তিল করে মারবে!’ তাদের রাখাল হাসি চাপিয়া বলিয়া উঠিল- ‘না, ওদের কথা শুনো না। ওদের পথ ভীতিসংকুল আর অনেক দূরে, তাও আবার দুঃখকষ্ট- কাঁটাপাথরভরা। তোমাদের মুক্তি ঐ সামনে।’
দুরন্ত পথিক চলিয়াছিল, সেই মুক্ত দেশের উদ্বোধন বাঁশির সুর ধরিয়া ।….. এইবার তাহার পথের বিভীষিকা জুলুম আরম্ভ করিল। পথিক দেখিল, ঐ পথ বাহিয়া যাওয়ার এক-আধটি অস্ফুট পদচিহ্ন এখনও যেন জাগিয়া রহিয়াছে। পথের বিভীষিকা তাহাদেরই মাথার খুলি এই নূতন পথিকের সামনে ফেলিয়া দিয়া বলল, এই দেখ এদের পরিণাম! সেই খুলি মাথায় করিয়া নূতন পথিক আর্তনাদ করিয়া উঠিল, আহ, এরাই তো আমায় ডাক দিয়েছে। আমি এমনি পরিণাম চাই। আমার মৃত্যতেই তো আমার শেষ নয়, আমার পশ্চাতে ঐ যে তরুণ যাত্রীর দল, ওদের মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। বিভীষিকা বলিল, ‘তুমি কে?’ পথিক হাসিয়া বলিল, “আমি চির মুক্তিকামী। এই যাদের খুলি পড়ে রয়েছে, তারা কেউ মরেনি। আমার মাঝেই তারা নূতন শক্তি, নূতন জীবন, নূতন আলোক নিয়ে এসেছে। এ মুক্তদল অমর!’ বিভীষিকা কাঁপিয়া উঠিল, ‘আমায় চেন না? আমি শৃঙ্খল। তুমি যাই বল, তোমাকে হত্যা করাই আমার ব্রত। মুক্তিকে বন্ধন দেওয়াই আমার লক্ষ্য। তোমাকে মরতে হবে।’ দুরন্ত পথিক বুক বাড়াইয়া বলিল, ‘মারো, বাঁধো, কিন্তু আমাকে তো বাঁধতে পারবে না; আমার তো মৃত্য নেই। আমি যে আবার আসব।’ বিভীষিকা পথ আগুলিয়া বলিল, ‘আমার যতক্ষণ শক্তি আছে, ততক্ষণ তুমি যতবারই আস তোমাকে বধ করব। শক্তি থাকে আমায় মারো, নতুবা আমার মার সহ্য করতে হবে।’
অনেক দূরে মুক্ত দেশের অলিন্দে এই পথের বিগত পথিক-সব জ্যোতির্ময় দেহ লইয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে আহ্বান করিতে লাগিল। পথিক বলিল, ‘কিন্তু এই জীবন দেওয়াটাই কি জীবনের সার্থকতা?’ মুক্তি-বাতায়ন হইতে মুক্ত আত্মাদের স্নিগ্ধ আর্দ্র কণ্ঠ কহিয়া উঠিল- হ ভাই! তোমাদের মৃত্যতে আর অমনি সহস্র প্রাণের উদ্বোধনই তোমার মরণের সার্থকতা। নিজে মরিয়া অন্যকে জাগানোতেই তোমার মৃত্য চির-জাগ্রত অমর। নবীন পথিক তাহার তরুণ বিশাল বক্ষ উন্মােচন করিয়া অগ্রে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘তবে চালাও খঞ্জর!’
পিছন হইতে তরুণ যাত্রীদল দুরন্ত পথিকের প্রাণ-শূন্য দেহ মাথায় তুলিয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল- ‘তুমি আবার এসো!’
অনেক দূরে দিগ্বলয়ের কোলে কাহাদের ঐকতান-সংগীত ধ্বনিয়া উঠিতে লাগিল-
‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী’
আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি!’