কুবের লক্ষ করিয়া আশ্চর্য হইল, এই আমিনুদ্দি আজ একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছে। হোসেন মিয়ার দিকে সে চাহিয়া নাই, সে চাহিয়া দেখিতেছে আমিনুদ্দিকে! আমিনুদ্দির অস্বস্তিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। জহরের মধ্যস্থতায় অনেকবার বিবাদ মিটিলেও মনে মনে আমিনুদ্দির উপর কুবেরের রাগ ছিল। চোখে চোখে মিলিতে সে চোখ ফিরাইয়া লইল।
কেহ কথা কহে না। কী ভাবিয়া হোসেন মিয়া হঠাৎ কুবেরকেই বিলম্বিত সম্ভাষণ জানাইয়া বসিল।
পিছে বইলা ক্যান কুবের বাই? আগাইয়া বও। খানাপিনা হয় নাই?
কুবের হঠাৎ বড়ো উল্লাস বোধ কবিল। আগাইয়া সকলের সামনে গিয়া বসিয়া বলিল, খাইছি মিয়া বাই।
বাঁ হাতে নিজেব লালচে দাড়ি মুঠা করিয়া ধরিয়া হোসেন মিয়া বলিল, গণেশরে দেহি না? গেছে কই?
কেডা জানে? ফিরতি বেলায় মেলার মদ্যি মাইজা কর্তা ডাইকা কয, গাঁয়ে ফেরস নাকি গণেশ?—মাছগুলা বাড়িতে দিয়া আসিস, লইয়া যা। কইয়া একডালা ইছামাচ দিলেন। মাছ দিবাব লাইগা গণশা কর্তাগো বাড়িতে গেছে সন্দ করি।
মেজোকর্তার নাম অনন্ত তালুকদার। কেতুপুর গ্রামখানি তাহারই। জেলেপাড়াব যাহারা দু-এক বিঘা জমি রাখে, মেজোকর্তাকেই তাহারা খাজনা দিয়া থাকে। মেজোকর্তার নামোল্লেখে সকলে মন দিয়া কুবেরের কথা শুনিল। হোসেন মিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কর্তা আলেন কবে?
আলেন আর বিষ্যুদবারে।
হীরু মাঝি চোখ মিটমিট করিতে করিতে বলিল, মাইজ কর্তার সগল সংবাদ দেহি রাখস কুবের, ভুবন সা-র লগে মামলার কী হইল ক দেহি?
কুবের বলিল, কর্তা হাঁসচরের দখল পাইছেন। ভুবন সা-র নায়েব নাকি কয়েদ হইছে খবর শুনি জ্যাঠা। সাঁইথির কুঞ্জ গোঁসাই সাক্ষী দিছে, স্যায় নাকি নিজের চোখে নায়েববে কর্তাগো কাছারি ঘরে আগুন দিতি দেখিলো।
পীতম বলিল, হ? তুই জানলি কিবা?
কুবের সগর্বে বলিল, ইডা কী জিগাও মামা? আমার জাননের বাকি কী? শেতলবাবুর ঠাঁই জানলাম।
শীতলের নামোল্লেখে পীতম মাঝি নিঝুম হইয়া গেল। নকুল শয়তানি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শেতলবাবু? তেনারে পালি কই কুবির?
কুবের হাসিয়া বলিল, নকুলদা য্যান পোলাপান, জান না কিছু। শীতলবাবুর ঠাঁই পয়সা পামু, কাল রাইতে আমাগোর যুগীর বাড়িতে তাগিদ দিবার গেছিলাম। পয়সা দিবাব মতলব ডাকাইতটার নাই, খাতির কইরা কইল, বয় রে কুবের তামুক খা। তামুক টানি রাজ্যির গল্প কইরা আইলাম। কইলি না পিত্যয় যারা নকুলদা, শেতলবাবু কয়, মাইজাবাবু দেনায় ডুবছে।
বুড়া পীতম মাঝি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, নকুল তখনও শয়তানি করিয়া বলিল, যুগীর না পোলা হইবো কুবির?
কুবের বলিল, কেডা জানে? মুটাইছে দেখলাম।
কে জানে, কী আশ্চর্য ইহাদের উপভোগ্য রসিকতা! যুগী পীতম মাঝির মেয়ে, সম্প্রতি জেলেপাড়ারই একধারে একখানা ঘর বাঁধিয়া মেজোকর্তার মুহুরি শীতল ঘোষের সঙ্গে বাস করিতেছে। এতলোকের মাঝে পীতমের সামনেই তাহার মেয়ের সম্বন্ধে নকুল যেমন অনায়াসে রসিকতা করে, সকলে হাসাহাসি করিয়া তাহা উপভোগও করে বিনা বাধায় ও বিনা দ্বিধায়।
পীতম রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলে, বাইর তুই আমার বাড়ির থেইকা নকুইলা, দূর হ!
নকুল মুচকি হাসিয়া বলে, গোসা কর ক্যান মামা! জবাব দিবার পার না মাইঝা কর্তা কুবিররে এত খাতির করে ক্যান–তাই জিগাইয়া? কুবেরের পোলা কেমন ধলা হইছে জিগাও।
কুবের মুষ্টি তুলিয়া বলে, মারুম কইলাম নকুইলা, মাইরা লাশ করুম তরে।
মনে হয়, সভার চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। রাসু ও হোসেন মিয়াকে উপলক্ষ করিয়া সভায় যে চাপা অসন্তোষ ও প্রতিবাদের ভাব আসিয়াছিল প্রসঙ্গান্তরে এখন তাহা বিলীন হইয়া গিয়াছে। ও বিষয়ে আর কাহারও কিছু বলিবার বা ভাবিবাব নাই। হোসেন মিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়!
বিয়ানে একরার বাড়িত যাইও রাসু বাই। পয়সা কড়ি পাইবা মালুম হয়, নিকাশ নিয়া খারিজ দিমু! ময়নাদ্বীপির জমিন না নিলি জঙ্গল কাটনের মজুরি দিই–খাওন পরন বাদ। কাইল যাইও। লালচে দাড়ির ফাঁকে হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসে, বলে, মন করতিছ, হোসেন মিয়া ঠক। তোমারে ঠকাইয়া হোসেন মিয়ার ফয়দা কিসির? কোন হালারে আমি জবরদস্তি ময়নাদ্বীপি নিছি? আপনা খুশিতে গেছিলা, ঝুট না কলি মানবা রাসু বাই। ফিরা আইবার মন ছিল, আমারে কতি পারলা না? একসাথে আইতাম?
রাসু ঘাড় নিচু করিয়া থাকে। আমিনুদ্দি বলে, যান নাকি মিয়া?
হ!
শোনেন। আমি ময়নাদ্বীপি যামু না। কইয়া থুইলাম।
হোসেন মিয়া তেমনি মৃদু মৃদু হাসে।
তোমারে যাতি কই নাই আমিনুদ্দি। খুশ না হলি ক্যান যাবা?
পাতলা পাঞ্জাবি ঘামে ভিজিয়া যাওয়ায় হোসেন মিয়ার বুকের নিবিড় লোমরাজি দেখা যাইতেছিল। সেইখানে হাত দিয়া সে আবার বলিল, জান দিয়া তোমাগো দরদ করি, এ্যানে আইজ তোমরা ঘা দিলা, এই দিলের মদ্যি–কুবের বাই, ঘর যাইবা নাকি?
কুবের সায় দিয়া উঠিয়া আসিল। দুজনে গোয়াল পার হইয়া নামিয়া গেল পথে। আকাশ নিবিড় মেঘে ঢাকিযা গিয়াছে, দুর্ভেদ্য অন্ধকারে জেলেপাড়ার পথ পায়ের তলেও হইযা আছে অদৃশ্য। অত্যন্ত সন্তর্পণে পা ফেলিয়া আগাইতে হয, দীর্ঘকালের পবিচয় না থাকিলে বাড়ির আনাচকানাচ দিয়া আঁকাবাঁকা পথ তাহারা খুঁজিয়া পাইত না। কুবেরের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া আকাশের জমানো মেঘ হঠাৎ গলিয়া যাওয়ায় চোখের পলকে তাহারা ভিজিয়া উঠিল। কুবেরের সঙ্গে হোসেন মিয়াও উঠিল গিয়া তাহার ভাঙা কুটিরে।
দাওয়ায় ছাট আসিতেছিল, হোসেন মিযাকে ঘরের মধ্যেই বসিতে দিতে হইল। কুবেরের দুই ছেলে লখা ও চণ্ডী ঘুমাইয়া পডিয়াছিল, জাগিয়া ছিল গোপি। চাটাইয়ের উপব জাঁকিয়া বসিয়া হোসেন মিয়া তাহাকে আদর করিয়া কাছে ডাকিল, বলিল, পিয়াস জানায় বিবিজান, পানি দিবা না? গোপি ঘটিতে জল আনিয়া দিলে আলগোছে মুখে ঢালিয়া দিযা ঘটিটা দাওয়ার প্রান্তদেশে রাখিল। ঘরের চাল বাহিয়া যে জলের ধারা পড়িতেছিল আঁজলা ভরিয়া সেই জল ধরিয়া ঘটির গাযে ঢালিয়া ঢালিয়া ঘটিটি গোপি করিয়া লইল শুদ্ধ।
রাত্রি বাড়িতে থাকে, বৃষ্টি ধরিবার লক্ষণ দেখা যায় না। পিসি টেঁকি ঘরে গিয়া ঝাঁপ বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়ে, ভাইদের পাশে শুইয়া গোপির দুচোখ ঘুমে জড়াইয়া আসে, শ্রান্ত কুবেরের চোয়াল ভাঙিয়া হাই উঠে, বাহিরে চলিতে থাকে অবিরাম বর্ষণ। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হইবার পর ঘরের ফুটা কোণ দিয়া ভিতরে জল পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, চাহিয়া দেখিয়া হোসেন মিয়া আপনা হইতে কাল সকালেই কুবেরের ঘর ছাইবার শণ দিবার কথা বলিয়াছে। কুবের একসময় উঠিয়া গিয়া মালার অবস্থা দেখিয়া আসে। বহু যত্নে কুবের তাহার আঁতুড়ের চারিদিকে বেড়ার সমস্ত ফুটা বন্ধ করিয়াছে, দাওয়ার এদিকটা ভাসিয়া গেলেও আঁতুড়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকিবার কোনো পথ নাই। মেঝেটাই শুধু হইয়া আছে ভিজা স্যাঁতসেঁতে যার কোনো প্রতিকার করার সাধ্য কুবেরের নাই। আর কটা দিন পরেই মালা এখান হইতে মুক্তি পাইবে। বুকে পিঠে তাহার যে অল্প অল্প ব্যথা হইয়াছে, কদিন এখানে থাকার ফলে সেটা বাড়িয়া না গেলেই বাঁচা যায়।
মালা ভয়ে ভয়ে বলে, আমারে দুগা মুড়ি চিড়া দিবা গো?
ক্যান, ভাত খাস নাই?
খাইছি। ভাতে টান পড়ল, পেট ভইরা খাই নাই। অখন খিদায় পেট জ্বলে।
জ্বালাইয়া মারস্ বাপু তুই। বলিয়া কুবের হাঁড়ি কলসি খুঁজিয়া পিসির নিজের জন্য লুকানো কতকগুলি চিড়া মালাকে আনিয়া দেয়। উঠিয়া বসিয়া অন্ধকারেই চিড়া মুখে দিয়া মালা বলে, হোসেন মিয়ারে খাইতে দিবা না?
কী দিমু?
মেলার থেইকা আম না আনছিলা? তাই দাও—করবা কী! খিদায় মানুষটা খুন হইয়া যায় না।
কুবেরের সহসা মনে পড়িয়া যায়। ভাবে, সিধুর কাছ হইতে যে মাংসের ব্যঞ্জন পাওযা গিয়াছে তাই দিয়া আতিথ্য করিলে মন্দ হয় না। মুসলমান মানুষ, মাংস বেশ পছন্দ করিবে। কিন্তু পরক্ষণেই এ বিষয়ে কুবেরের উৎসাহ কমিয়া যায়। এমন একদিন ছিল হোসেন মিয়া যখন খাসির মাথার ব্যঞ্জন পাইলে ধন্য হইয়া যাইত, আজ যার তার রান্না ও সব কী আর সে খাইবে? শুধু না খাওয়া নয়, খাইতে বলিলে হয়তো সে আজ অপমানই বোধ করিয়া বসিবে। তার চেয়ে আম যখন আছে, তাই দেওয়া ভালো।
ঘরে গিয়ে কুবের একটু অবাক হয়। চাটাইয়ে চিত হইয়া শুইযা ইতিমধ্যেই হোসেন মিযা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কুবের সন্তর্পণে মৃদুস্বরে একরার বলে, মিয়া বাই? সাড়া না পাইয়া ঠেলা দিয়া ঘুম ভাঙায় গোপির।
সিধুর ঠাঁই ব্যানুন আনছিলি গোপি?
ঘুমে আধমরা গোপি বলে, উঁহুঁ।
উঁহু! আনতি কইয়া গেলাম না হারামজাদি?
বাহুমূলে কুবেরের জোর টিপুনিতে গোপি চমকিয়া সজাগ হইয়া বসে বলে, আনতি গেছিলাম বাবা। দিল না। কইল, বিড়ালে সব খাইযা গেছে গা।
বিড়ালে খাইয়া গেছে কইল, না?
গোপি সায় দিল। কুবের রাগে আগুন হইযা বলিল, হালা জুয়াচ্চোর। ব বিয়ানে খাওযামুনে বিড়ালরে। হালা বজ্জাইত!
ছাড়া পাইবামাত্র গোপি ঢলিয়া পড়ে। ঘুম বোধ হয় আসে তাহার সঙ্গে সঙ্গেই। ঘরের যে কোণে জল পড়িতেছিল কুবের সেখানটা পরীক্ষা করিয়া দ্যাখে। জল বাহির হইয়া যাইবার জন্য সেখানে সে একটি সরু নালি করিযা দিয়াছিল, মাটি গলিয়া তাহা প্রায় বুজিয়া আসিয়াছে। জল জমিয়া ঘরের ভিতরের দিকে আগাইয়া আসিয়াছে অনেকদূর। হাত দিয়াই নালিটা সাফ করিয়া কুবের জল বাহির করিয়া দেয়। তারপর এক গভীর সমস্যার কথা ভাবিতে থাকে। ডিবরিতে বেশি তেল নাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিভিয়া যাইবে। হোসেন মিয়াকে ডাকিয়া তুলিয়া আম খাওয়ার অনুরোধ এখন সে জানাইবে কী? বাদলা নামিয়া ঠাণ্ডা পড়িয়াছে। লোকটা আরামে গভীরভাবে ঘুমাইতেছে। ডাকিলে চটিবে না তো?
ঘুমের মধ্যে হোসেন মিয়া পাশ ফিরিল। দ্যাখো, হঠাৎ কুবের কী আবিষ্কার করিয়াছে। হোসেন মিয়ার লম্বা পাঞ্জাবির পকেট হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে আনকোরা নতুন একটা টাকাপয়সা রাখিবার ব্যাগ! ব্যাগটা সে আজই মেলায় কিনিয়াছে সন্দেহ নাই। শখ করিয়া নতুন ব্যাগে কত টাকা পয়সা হোসেন মিয়া রাখিয়াছে কে জানে, ব্যাগটা ফুলিয়া মোটা হইয়া গিয়াছে।
কুবেরের দেহে কাঁপুনি ধরিয়া যায়। একমুঠা টাকা ও রেজকি হইতে প্রথমে সে একটা আধুলি ছাড়া আর কিছু লইতে সাহস পায় না। তারপর সে ভাবিয়া দ্যাখে যে এতগুলি খুচরা রেজকি কি আর হোসেন মিয়া হিসাব করিয়া গুনিয়া গাঁথিয়া রাখিযাছে? আরও একটা সিকি এবং একটা আনি সে বাহির করিয়া লয়।
ব্যাগটা হোসেন মিয়ার লম্বা পাঞ্জাবিব পকেটে ঢুকাইয়া ফুঁ দিয়া সে ডিবরিটা নিবাইয়া দেয়। তখন একটা বড়ো ভয়ানক ব্যাপার ঘটিয়া যায়।
গোপি রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে, বাবা!
কুবেবের দেহ শিরশির করে, মেবুদণ্ডটার ঠিক মাঝামাঝি।
চুপ যা গোপি, ঘুম যা।
আমারে কাইল পয়সা দিবা।
দিমু—চুপ যা, ঘুম যা গোপি।
গোপি আর কথা বলে না। অন্ধকারে দুহাত লম্বা ছোটো চাটাইটি সন্তর্পণে বিছাইয়া কুবের শুইযা পড়ে।