পরের ধনে পোদ্দারী
– জসীম উদ্দীন

আগে মৌলবি সাহেবের ঘন ঘন দাওয়াত আসিত । তালেব এলেমের (ছাত্রদের) কাঁধে কেতাব কোরান দিয়া বড়ই জাকজমকের সঙ্গে মৌলবি সাহেব দাওয়াত খাইতে যাইতেন। কিন্তু এখন খারাপ দিন পড়িয়াছে । লােকে বড় মৌলবি সাহেবের খোঁজ করে না।

অনেক দিন পরে দূরের একটা গ্রাম হইতে মৌলবি সাহেব দাওয়াত পাইলেন । বর্ষার দিন। পানির ভিতর হইতে নৌকাকানা মৌলবি সাহেব নিজেই সেচিলেন ।

তাহার উপর তক্তার পাটাতন লাগাইয়া ছই বসাইলেন । কিন্তু সঙ্গে তালেব এলেম না থাকিলে ত মান থাকে না।

আগে বহু তালেব-এলেম সঙ্গে থাকিত। এখন গরিব অবস্থায় তাহারা সকলেই চলিয়া গিয়াছে। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া একজন তালেব-এলেমের কথা মৌলবি সাহেবের মনে হইল।

গ্রামে একজন বিধবা স্ত্রীলােক ছিল। তাহার একটিমাত্র ছেলে। পাড়া ভরিয়া ডাণ্ডা-গুলি খেলিয়া বেড়ায়। মৌলবি সাহেব সেই বিধবার বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। বিধবা বড়ই গরিব। মৌলবি সাহেবকে কোথায় বসিতে দেয় সেইজন্য খুবই ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

মৌলবি সাহেব বলিলেন, “আমার জন্য ব্যস্ত হইবেন না। আমি সামান্য দরকারে আসিয়াছি।”

মাথার ঘােমটাটি আরও একটু টানিয়া বিধবা বলিল, “আমার মতাে গরিব বিধবা আপনার কি কাজে লাগিতে পারে ?” | মৌলবি সাহেব একটু কাশিয়া বলিলেন, “আমি দূরের গ্রাম হইতে একটি দাওয়াত পাইয়াছি। আপনার ছেলেকে যদি আমার সঙ্গে দেন সে আমার তালেব-এলেম হইয়া কেতাবগুলি বহিয়া লইয়া যাইবে।”

বিধবা একগাল হাসিয়া বলিল, “তাহাতে আর কি হইয়াছে, আমার ছেলেটি ত পাড়ায় পাড়ায় খেলিয়া বেড়ায়। আপনার সঙ্গে থাকিয়া যদি একটু এলেম-কালাম পড়ে সে ত ভালই হইবে । আপনি এখনই তাহাকে লইয়া যান। ওরে আরমান! তুই মৌলবি সাহেবের সঙ্গে যা।”

মৌলবি সাহেব ছেলেটির হাত ধরিয়া একটু ইতস্তত করিয়া কহিলেন, “আরও একটি কথা। দাওয়াতে যে যাইব, আমার পরিবার কাপড়খানাও ছিড়িয়া গিয়াছে। আপনার ডুমাখানা যদি দেন তবে লুঙ্গির মতাে করিয়া পরিয়া দাওয়াতে যাইতে পারি । সেখান হইতে আসিয়াই আপনার ডুমাখানা ফেরত দিয়া দিব।”

পূর্বে গ্রামের মেয়েরা লুঙ্গির মতাে করিয়া একখণ্ড কাপড় পরিত, অন্য একখণ্ড বুকে জড়াইত। তাহাকে ডুমা বলিত।

বিধবা একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “তা নিবেন নিন। আমারও বেশি কাপড় নাই। তা নাহয় একদিন কষ্ট করিয়াই কাটাইব।” মৌলবি সাহেব বিধবার ডুমাখানা গলায় জড়াইয়া ছেলেটিকে সঙ্গে করিয়া বাড়ি আসিলেন।

আগের দিনে মৌলবি সাহেব দাওয়াতে যাইতেন, তাকিয়া বালিশ সঙ্গে লইতেন। তাহা দেখিয়া লােকে মৌলবি সাহেবকে কত সমীহ করিয়া চলিত। আজও কি তাকিয়া-বালিশ সঙ্গে লওয়া যায় না ? তুলার বালিশটি তেলে ময়লায় বড়ই নােংরা হইয়া আছে। তা হােক, সেটাতেই চলিবে, কিন্তু তাকিয়া কোথায় পাওয়া যাইবে ? ঘরের মধ্যে কিছু খড় ছিল, তাহা দিয়া মৌলবি সাহেব একটি তাকিয়া তৈরি করিলেন। তাহা অতি পরিপাটি করিয়া ন্যাকড়া দিয়া জড়াইয়া লইলেন। লােকে যেন বুঝিতে না পারে ইহা খড় দিয়া তৈরি। ছােকরা তালেব-এলেম সবই দেখিল। বালিশ ও তাকিয়া নৌকার ছইয়ের মধ্যে রাখিয়া মৌলবি সাহেব দাওয়াতে চলিলেন।

সারাটি পথ মৌলবি সাহেব নিজেই নৌকা বাহিয়া চলিলেন। যে-বাড়িতে যাইবেন, সে-বাড়ির ঘাটের কাছে আসিয়া বৈঠাখানা ছােকরা তালেব-এলেমের হাতে দিয়া মৌলবি সাহেব ছই-এর মধ্যে ভালমতাে আমিরি-চালে যাইয়া বসিলেন। | নৌকা ঘাটে আসিয়া ভিড়িল । নিমন্ত্রণ-বাড়ির লােকেরা ব্যস্ত। সমস্ত হইয়া মৌলবি সাহেবকে অতি সমাদরে নৌকা হইতে হাত ধরিয়া নামাইল। তারপর বৈঠকখানায় লইয়া গিয়া বসাইল। সকলে মিলিয়া, হুঁকো আনরে, —‘ওজুর পানি আনরে’ বলিয়া সমস্ত বাড়ি সরগরম করিয়া তুলিল।

মৌলবি সাহেব সেখানে বসিয়া আমিরি-চালে ছােকরা তালেব-এলেমকে হুকুম করিলেন, “ওরে! অমার তাকিয়া-বালিশ লইয়া আয়।” আলেম-এলেম গরিব বিধবার পুত্র। তাকিয়া কোনটা আর বালিশ কোনটা জানে না। সে ইতস্তত করিতেছিল।

মৌলবি সাহেব ধমকের সুরে বলিলেন “ওরে কথা শুনিতেছিস না কেন? আমার তাকিয়া-বালিশ লইয়া আয়।”

বালক দূর হইতে চেঁচাইয়া উত্তর করিল, “মৌলবি সাহেব! কোনটা আনিব ? খড়েরটা না তুলারটা ?”

জবাব শুনিয়া সভার লােক একটু মুচকি হাসিল ।।

মৌলবি সাহেব রাগিয়া মাগিয়া বলিলেন, “ওরে বেয়াল্লিক উলুক, তাকিয়া আবার খড়ের কিরে?”

ছেলেটি উত্তর করিল, “আপনি যেটা খড় দিয়া তৈরি করিয়া ন্যাকড়া দিয়া জড়াইয়া আনিয়াছেন সেইটা আনিব নাকি?”

সভার লােক এ ওর মুখের দিকে চাহিয়া আবার হাসিল। মৌলবি সাহেব এবার আরও রাগের সঙ্গে বলিলেন, “চুপ থাক্‌ বেয়াদব । আমার তাকিয়া লইয়া আয়।”

ছেলেটি তখন কাঁদ-কদ হইয়া বলিল, “মৌলবি সাহেব। আপনার রাগের কি ধার ধারি ? আপনি আমার মার ডুমাখানা লুঙ্গির মতন করিয়া পরিয়া আসিয়াছেন, সেটা আমাকে দিন। আমি বাড়ি যাই।”

– সভার লােক আবার হাসিয়া উঠিল ।