বুলু
– অজিত কুমার গুহ

সেদিনের কথা আমার এখনো খুব মনে পড়ে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনদিন থাকার পরই আমাদের কয়েকজনকে বদলি করা হলো দিনাজপুর কারাগারে। তোমরা সবাই জানো কিনা বলতে পারিনে, সরকারি কর্মচারীর মতো সরকারি কয়েদিরও বদলি আছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাদের অবস্থানটা কর্তৃপক্ষের কোনো অজানা কারণে মনঃপূত নয়, তাই আমাদের যেতে হবে সুদূর উত্তরবঙ্গে দিনাজপুরে।

রাত নটার সময় গাড়িতে চেপেছি। বাহাদুরাবাদ ঘাটে গিয়ে যখন নেমেছি, তখন ভোর হয় হয়। খেয়া পারাপারের স্টিমারে যখন উঠেছি, তখন চারদিক অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেক দূরে দূরে নৌকাগুলোর ভেতর থেকে কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। শুধু যমুনার কালো জলের উপর ভোরের প্রথম আভা এসে পড়েছে আর ঝিকমিক করে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ শোনা যায়। ভোর হতেই কিন্তু পট পরিবর্তন হয়ে গেলো। অনেকগুলো পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনেই তাকিয়ে দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী এই স্টিমারেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। যদিও আমাদের সঙ্গে গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও পুলিশের লোক ছিল, তবুও আমরা খোলাখুলিই ছাত্রদের সাথে আলাপ করলাম, আর একসঙ্গে বসে চা-ও খেলাম। তারপর খেয়া পার হয়ে আবার রেলগাড়িতে চেপে দিনাজপুর স্টেশনে এসে নেমেছি।

মনটা খুব দমে গেল। কোথায় আমার চিরপরিচিত ঢাকা আর কোথায় উত্তরবঙ্গের এই প্রান্তসীমার দিনাজপুর। গাড়ি থেকে নামতেই টের পেলাম যে, হিমালয়ের কাছাকাছি এসেছি। ফাল্গুন মাস। বেলা প্রায় এগারোটা, তবু বেশ শীত। একটা চাঁদর গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ডেপুটি-জেলর অফিসেই ছিলেন। গম্ভীর স্বরে আমাদের বসতে বললেন। ইতোমধ্যে আমাদের আসার খবর পেয়ে জেলর সাহেব ছুটে এলেন। এক নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের নিয়ে গেলেন। পরিচ্ছন একটি বাংলো ঘর। সামনে এক ফালি উঠোন। মাঝখানে একটি বাতাবি লেবুর গাছ, ফুলে ফুলে একেবারে ছেয়ে আছে; অজস্র মৌমাছি এসে জমেছে আর ফাল্গুনের এলোমেলো বাতাসে চারিদিকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। শুনতে পেলাম, কবি কাজী নজরুল ইসলাম নাকি বন্দি হিসেবে এই জেলে বেশ কিছুদিন ছিলেন। ঐ বাতাবি লেবু গাছের নিচে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে নাকি কবি লিখতেন। ভাবতে পারো, এই খবরটা পেয়ে কেমন লাগলো আমার?

মনটা তবু খুবই বিষণ্ণ ছিল। সম্পূর্ণ একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা মনের মধ্যে ভারি হয়ে আছে। আমরা তিনজন অধ্যাপক ও স্থানীয় একজন উকিল মোট চারজন থাকি এই বাংলোয়, আর থাকে আমাদের কাজ করার জন্য সাধারণ কয়েদি, যাদের জেলখানার নাম হচ্ছে ‘ফালতু’।

বিকেল বেলা জেলের ডাক্তার সাহেব এলেন। ভদ্রলোককে দেখেই আমার ভালো লাগলো। লম্বা, গৌরবর্ণ, প্রশস্ত ললাট- সমস্ত চেহারায় একটা প্রশান্ত নম্রতা। আলাপ করে খুব খুশি হলাম। আমাদের বললেন, আমাকে স্যার, ছাত্রই মনে করবেন, যখন যেটি দরকার নিঃসঙ্কোচে বলবেন, আমি আপনাদের পরিচর্যার জন্যেই রয়েছি। পরদিন সকালে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাক্তার বিদায় হলেন। ডাক্তারের এই একান্ত আপনজনের মতো ব্যবহারে মনটা অনেকখানি হালকা হয়ে গিয়েছিল।

পরদিন ডাক্তার এলেন। সঙ্গে বছর পাঁচেক বয়সের একটি সুন্দর ফুটফুটে ছেলে। দেখেই আমার খুব ভালো লাগল। ডাক্তার বললেন, আমার ছেলে আপনাদের দেখতে এসেছে। আমি বললাম, খুব ভালো কথা। এমন একজন মহামান্য অতিথি পেয়ে আমরাও ধন্য হয়েছি। বলে কোলে তুলে নিতেই ও বিনা দ্বিধায় আমার কোলে এলো। আদর করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী বল তো? উত্তরে বলতে লাগলো, আমার নাম বুলু, আমার বাবার নাম শাহেদ, আমার মায়ের নাম শামীম, আমার নানার নাম — হঠাৎ ডাক্তারের চোখে চোখ পড়তেই ও থেমে গেল। আমি বলে উঠলাম, হয়েছে, খুব হয়েছে। একেবারে এত নাম কি আমি মনে রাখতে পারি? টেবিল থেকে বিস্কুট এনে ওকে দিলাম। বুলু বেশ সহজভাবেই খেতে লাগল। তারপর টেবিলের উপর আমার বইগুলো দেখে আমায় বললে, তুমি পড়? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে বলতে লাগল, আমিও পড়ি- টিয়ে মার বিয়ে লাল গামছা দিয়ে — ইত্যাদি ইত্যাদি। কার সাধ্য থামায় ওকে। আমি বললাম, আমি তোমার মতো পারিনে। অল্প অল্প পারি। শুনে ও খুব হাসল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এত বড়-পড়তে পার না? তারপর সে কি হাসি। অবশেষে ডাক্তার ওকে থামালেন।

সেদিন বুলু চলে গেল। কিন্তু পরদিন আবার ঠিক সময় মতো এসে হাজির! ডাক্তার বললেন, কিছুতেই ওকে বাড়ি রাখা গেল না। ও আসবেই। হাতে একটি ছড়ার বই, ঐটি আমাকে পড়ে শোনাবে বলে নিয়ে এসেছে। অগত্যা আমাকে ওসব শুনতে হলো। ডাক্তার সংকুচিত হয়ে বললেন, আপনাকে ও প্রতিদিন খুব বিরক্ত করে। আপনার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়। আমি বললাম, এমন বিরক্ত করার লোক এই বিচ্ছিনতার দ্বীপে কোথায় পাব আমি। বুলু না এলে আমার খুব খারাপ লাগবে।

ডাক্তারও আমার অনুরোধে রোজই বুলুকে নিয়ে আসতেন। বুলুকে নিয়ে সময় আমার বেশ ভালোই কাটত। ও চলে গেলেই কেমন খালি খালি লাগত।

বদলির জন্যে দরখাস্ত করেছিলাম। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম, আমার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। আবার আমি ঢাকা জেলে ফিরে যেতে পারব। খবর পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। আবার বুলুর কথা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল! ওকে ছেড়ে থাকতে হবে- এ কথাটা যেন আর ভাবতেই পারিনে। তবু আবার ঢাকা চলে আসতে হলো।

আসবার দিন সকাল বেলায়ই ডাক্তারের সাথে বুলুও এলো। আদর করে ওকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে ওকে বললাম, বুলু, আমি ঢাকা যাবো। তুমি আমার কাছে কী চাও?

ও প্রথমে বললো, আমিও ঢাকা যাবো। তারপর কী ভেবে হঠাৎ আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললো, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমীনের কল্লা চাই’। আমি তো অবাক! এ কী কথা এতটুকু শিশুর মুখে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ডাক্তার সাহেব, এবার আপনার সরকারি চাকুরি রাখা কঠিন হবে। ছেলের মুখে এ সব কী শুনছি।

ডাক্তার অসহায়ের মতো বললেন, কী করব স্যার, জেলখানার সামনেই বাসা। রাতদিন মিছিলের মুখে ঐ কথাই শুনে শুনে মুখস্থ করে রেখেছে। আমি ঠেকাব কী করে?

এরপর দিনাজপুর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবার ফিরে এসেছি। প্রথম; কদিন বুলুর জন্যে খুব মন কেমন করতো তারপর আবার ভুলে গিয়েছিলাম।

এতদিনের বিচিত্র পরিবর্তনে এসব কাহিনী ভুলেই গিয়েছিলাম। আর এ কাহিনী বলবার কথাও মনে হতো না, যদি না সেদিন আর এক কান্ড ঘটতো। সেদিনের পরে সতেরো বছর চলে গেছে। এক সাহিত্য সভা থেকে বাসায় ফিরছি। বাসার সামনে রিকশা থেকে নামার পরেই হঠাৎ এক ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন: আমায় চিনতে পারেন স্যার? আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি। আমার নাম শাহেদ। আমি ডাক্তার। আপনি যখন দিনাজপুর জেলে, তখন আমি ছিলাম সেখানে ডাক্তার।

তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে সেই সতেরো বছর আগেকার ডাক্তার সাহেবের চেহারার কোনো মিলই যেন পাইনে। হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, আপনার বুলুকে মনে আছে স্যার, বুলু? ও এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বেরিয়েছিল। চাকুরিও পেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সেদিন মশাল হাতে বেরিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না।

ডাক্তার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আমি স্তব্ধ রুদ্ধবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেম। বহুদিনের বিস্মৃতির অন্ধকারে যে ছবিটি আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল, তা বাইশ বছরের যুবকের নয়, পাঁচ বছরের একটি ছোট্ট শিশুর। আর মনে হলো: কানের কাছে যেন ফিস ফিস করে সে বলছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেম। কোন কথাই বলতে পারলাম না তাঁকে।