মানুষ কী নিয়ে বাঁচে
– লিও টলস্টয়

এক

 

এক মুচি তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে একজন চাষীর বাড়ির এককোণে পড়ে থাকত। তার নিজের ঘর বাড়ি জমি-জমা কিছুই ছিল না। মুচির কাজ করেই সে তার সংসার চালাত।

তখন রুটির দাম ছিল চড়া, আর মজুরি ছিল কম; কাজেই রুজি-রোজগার যা হত দেখতে না-দেখতেই তা যেত ফুরিয়ে।

মুচি আর তার স্ত্রী একটিমাত্র চামড়ার কোট ভাগাভাগি করে গায়ে দিত। সেকোর্টটারও তখন জীর্ণ দশা। তাই সে একটা নতুন কোট বানাবে বলে ভেড়ার চামড়া কিনবার জন্য তৈরি হতে লাগল।

শীত পড়বার মুখেই মুচির হাতে বেশকিছু টাকা জমল ; তার স্ত্রীর ট্রাঙ্কে জমল তিন রুবল, আর গায়ের চাষীদের কাছে তার পাওনা হল পাঁচচ রুবল কুড়ি কোপেক।

একদিন সকালে মুচি তার বউয়ের সুতির জ্যাকেট পরল শার্টের উপর, তার উপর চড়াল তার গরম কাফতান। তারপর তিন রুবল পকেটে ফেলে বেড়াবার একটা লাঠি কেটে নিয়ে রওনা হল।

যেতে যেতে ভাবল : “চাষীদের কাছ থেকে আগে পাঁচচ রুবল আদায় করব, তার সঙ্গে যোগ করব পকেটের তিন রুবল; আর তাই দিয়ে কিনব নতুন কোটের জন্য একটা ভেড়ার চামড়া।”

গাঁয়ে পৌঁছে প্রথমে গেল একজন চাষীর বাড়ি। চাষী তখন বাড়ি নেই। তার বউ বলল, “এখন তো কিছু দিতে পারব না, তবে এক হপ্তার মধ্যে টাকা-সমেত আমার স্বামীকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।”

গেল আর-একজন চাষীর কাছে। সে দিব্যি করে বলল, তার হাত একেবারে খালি; তবু জুতো-সারানো বাবদ দেয় কুড়ি কোপেকের ছোটঋণটা কোনোরকমে শোধ করে দেবে।

মুচি মনে মনে ভাবল, নাহয় ধারেই ভেড়ার চামড়াটা কেনা যাবে। কিন্তু চামড়ার দোকানির মুখে অন্য কথা। সে বলল, “পুরো টাকাটা দিয়ে পছন্দমতো চামড়া নিয়ে যাও | দেনা শোধ করা যে কী জিনিস সে আমি ভালোই জানি।”

সারা সকাল ঘুরে জুতো-সেলাই বাবদ কুড়ি কোপে আর মেরামতের জন্য একজোড়া জুতো হাতে পাওয়া ছাড়া আর কিছুই তার কপালে জুটল না।।

মুচির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কুড়ি কোপেক দিয়ে মদ খেয়ে বাড়ির পথ ধরল।

সকালবেলা থেকেই তার বেশ শীত-শীত করছিল। কিন্তু এখন মদ খাবার পরে গরম কোট ছাড়াই শরীর বেশ গরম লাগছিল। এক হাতে লাঠি দিয়ে পথের বরফের টুকরাগুলোকে ঠুকতে ঠুকতে এবং অন্য হাতে মেরামতির জুতোজোড়ার ফিতে ধরে ঝোলাতে ঝোলাতে পথ চলতে লাগল মুচি। আর নিজের মনেই বলতে লাগল :

“কোট ছাড়াই বেশ তো গরম লাগছে। খেয়েছি তো একটুখানি, তাতেই তো দেখছি শিরার ভিতর যেন খই ফুটছে। তবে আর ভেড়ার চামড়ার দরকারটা কী! অবশ্যি বাড়িতে বউ আছে। সে আবার এই নিয়ে খিটিমিটি করবে। আচ্ছা, এও তো বড় লজ্জার কথা। তুমি একজনের কাজ করে দেবে আর সে তোমাকে কলা দেখাবে। ঠিক আছে, সবুর করো বাছাধন, এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমার টাকা না দিয়ে যাও, তাহলে তোমার মাথার টুপি আমি খুলে নেব। মজা মন্দ নয়! ওই আর একজন কুড়ি কোপেক যেন আমাকে ভিক্ষা দিলেন! কুড়ি কোপেকে কী হবে? দিব্যি গেলে বলল, হাত একেবারে ফাকা। আমিও তো বলতে পারতাম, শুধু কি তোমার হাতই ফাকা? আমার হাত ফাঁকা নয়? আমার তো যা-কিছু সব এই কাঁধে। তোমার খাবার তুমি ক্ষেতে ফলাও, আর আমাকে তা কিনতে হয়। ফি হপ্তায় তিন রুবলের তো রুটিই কিনতে হয়। তাও আবার কোনোদিন হয়তো বাড়ি ফিরে দেখি রুটি ফুরিয়ে গেছে তখন আবার দেড় রুবলের ধাক্কা। কাজেই আমার যা পাওনা আমাকে দিয়ে দাও।”

এমনিধারা ভাবতে ভাবতে মুচি চলছে। রাস্তাটা মোড় ঘুরতেই একটা গির্জা, গির্জার গায়ে একটা শাদমতো কী যেন তার নজরে পড়ল।

তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ভালো করে নজর করেও জিনিশটা যে কী তা সে ঠিক ঠাওর করতে পারল না। ভাবল, “দেখতে অনেকটা যেন মানুষের মতো; তবে সারাটা দেহ কেমন যেন শাদা। তাছাড়া, মানুষ ওখানে করবেই বা কী?”

আরও কাছে এগিয়ে সবটা পরিষ্কার দেখতে পেল। কী আশ্চর্য, গির্জার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা মানুষ। মৃতই হোক আর জীবিতই হোক, বসে আছে একেবারে উলঙ্গ আর নিচুপ হয়ে।

মুচি ভয়ে শিউরে উঠল। ভাবল, “নিশ্চয় কেউ লোকটাকে খুন করে জামাকাপড় খুলে নিয়ে এখানে ফেলে গেছে। পালাই বাবা, কাজ এসব ঝঞ্চাটে জড়িয়ে !”

মুচি লোকটাকে পেরিয়ে গেল। গির্জার অপরদিকে পৌছতেই লোকটাকে আর দেখা গেল । কিন্তু আরও খানিক এগিয়ে পিছন ফিরে চাইতেই দেখে, লোকটা যেন গির্জা থেকে সরে এসে নড়ছে আর তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মুচি আরও ভয় পেয়ে গেল। ভাবল, “লোকটা যে কে তাই-বা কে জানে! ভালো হলে এভাবে আসবে কেন। কাছে গেলে যদি লাফিয়ে পড়ে গলা চেপে ধরে, ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া শক্ত হবে। যদি তা নাও করে, সে তো আমার ঘাড়ে চাপবে। ওরকম একটা ন্যাংটো লোককে নিয়ে করবই বা কী? নিজের গায়ের সামান্য জামা কাপড় তো ওকে খুলে দিতে পারব! ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন।”

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল মুচি। কিছুদূযেতে-না-যেতেই বিবেক তাকে খোচাতে শুরু করল। “কী করছ তুমি সাইমন? একটা মানুষ মরতে বসেছে, আর তুমি তাকে ভয় পাচ্ছ? তুমি কি এতই ধনী যে টাকা-পয়সা চুরি যাবার ভয় করছ ? ধিক তোমাকে সাইমন, ধিক!”

সাইমন মুখ ঘুরিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে চলল।