তিন
উনিশশো বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমবার দেখা করতে গেলাম। তখন তিনি বাড়ি বদল করেছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের বাঁদিকের চোঙাআলা দোতলা বাড়িটিতে উঠে এসেছেন। (বর্তমানে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।) প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে বসবাস করছেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা-ভ্রাতৃবধূ এবং তাদের ছেলেমেয়েরা। শুধু বাড়ি-বদল নয়, অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে গেছে। প্রফেসর রাজ্জাক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে আরম্ভ করেছেন। তা ছাড়া তাকে জাতীয় অধ্যাপকও বানানো হয়েছে। পূর্বতন চেয়ারম্যান ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্যের পদে আসীন হয়েছেন। মোজাফফর সাহেব ছিলেন প্রফেসর রাজ্জাকের একান্ত স্নেহভাজন ছাত্র।
রাজ্জাক সাহেবের চেহারার মধ্যেও একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পেলাম। তার থুতনিতে একগোছা দাড়ি এই সময়ের মধ্যে গজিয়ে গেছে। এই নতুন জন্মানো দাড়ির গোছাটি তার মুখের আদল একেবারে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। পাঞ্জাবি পাজামার পরিবর্তে তিনি যদি কলারহীন লম্বা শার্ট এবং প্যান্ট পরতেন, অবিকল ভিয়েতনামের হোচি মিন বলে চালিয়ে দেয়া যেতো। বাস্তবিকই নতুন জন্মানো শ্মশ্রুর গোছাটিতে তাঁর মুখের রেখাগুলো অনেক ধারালো দেখায়। তিনি জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের এই নয় মাস তাকে কেরানিগঞ্জের নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিলো এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি দাড়ির গোছাটি এক রকম বিনা পরিচর্যায় গজিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাকে কেউ-কেউ বলেছেন, এই চোঙাআলা বাড়িতে একসময় কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার বসবাস করে গেছেন। সত্য মিথ্যা পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় যখন উঠেছি। ছাঁৎ করে বুদ্ধদেব বসুর একটা গল্পের কথা মনে এল। গল্পটির নাম সবিতা দেবী। মোহিতবাবু ছিলেন তরুণ লেখক-কবিদের ওপর ভীষণ খড়গহস্ত। সুযোগ পেলেই নানাভাবে নাজেহাল করতেন। তরুণরাও মজুমদার মশায়ের ওপর বদলা নিতেন। বুদ্ধদেব বসু মোহিতলাল মজুমদারকে নিয়ে এই শ্লেষাত্মক গল্পটি লিখেছিলেন, তা নাও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে মোহিতলাল মজুমদারের ছবিটি ভেসে উঠেছিলো। গল্পটির এক জায়গায় আছে, গল্পের নায়িকা সবিতা দেবীকে এক বৃষ্টির দিনে রচনা পাঠ করে শোনাতে গিয়েছিলেন। ঘরে প্রবেশ করার আগে ছাতাটি সিঁড়ির কাছে রেখে গিয়েছিলেন। সেই ছত্রনিঃসৃত একটি জলের রেখা এঁকেবেঁকে সিঁড়ির ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিলো। প্রফেসর রাজ্জাকের বাড়ির সিড়ি ভাঙতে গিয়ে সেই জলের রেখাটি শুস্ক ফেব্রুয়ারি মাসেও আমার মনে ছলছলিয়ে জেগে উঠেছিলো। এর সবটাই হয়তো কল্পনা। হয়তো বুদ্ধদেব বসু মোহিতলালকে উপলক্ষ করে গল্পটি লেখেননি। যে সিঁড়ির কথা বুদ্ধদেব বলেছেন, সেটা তার কল্পনাতেই জন্ম নিয়েছিল। এটা সে সিঁড়ি নয়। মানুষের মন ভারি বিদঘুটে জিনিস। কত অসম্ভব বস্তুর কল্পনা করে।
আমি যখন সিঁড়ি ভেঙে রাজ্জাক সাহেবের ঘরে গেলাম, দেখি তিনি একখানি কথা গায়ে দিয়ে গুড় কি গুড় কি হঁকা টানছেন। আমাকে দেখামাত্রই তার মুখমণ্ডল ভেদ করে একটা সুন্দর হাসি বিকশিত হয়ে উঠলো। আরে মৌলবি আহমদ ছফা যে! আয়েন, আয়েন, তাইলে বাঁইচা আছেন। আত্মীয়স্বজন সকলের কী দশা?
আমি বললাম, সকলে বেঁচে আছেন।
আপনি কই আছিলেন?
আমি বললাম, পুরো সময়টা আমি ভারতে কাটিয়েছি।
তিনি ফের জিগ্গেস করলেন, দেশের বাড়িতে যাইয়া খবরটবর নিছেন?
আমি জবাব দিলাম, ঢাকা এসেই বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। সপ্তাহখানেক আগে ফিরে এসেছি।
আপনের বাড়িতে কে কে আছে?
মা, ভায়ের ছেলেমেয়ে এবং ভাবি। বোনদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
এই সময়ে ছোটো একটি বাচ্চা এসে খবর দিল নাস্তা দেয়া হয়েছে। রাজ্জাক সাহেব আমাকে বললেন, আয়েন মৌলবি আহমদ ছফা, আমাগো লগে সামান্য নাস্তা করেন।
আমি বললাম, স্যার, হল কেন্টিনে গিয়ে নাস্তা করবো।
তিনি বললেন, আমাগো লগে সামান্য কিছু মুখে দেন, তারপর যদি পেটে ক্ষিধা থাকে। ঘরে যাইয়া আবার খাইয়েন।
পাশের রুমে গিয়ে দেখি বিরাট এক টেবিলের চারপাশে চেয়ার পাতা হয়েছে। পরিবারের সকলে জড়ো হয়েছেন। রাজ্জাক স্যারের ছোট ভাই, তাঁর বেগম, দুই কন্যা, ছেলেরা। একজন অতিথিও ছিলেন। উনাকে রাজ্জাক স্যার মামা ডাকতেন। একটা বড় চীনামাটির প্লেটে চৌকোণা সাইজের পুরু পরোটার স্তুপ। ভুনা গরুর মাংস। চিতই পিঠের সঙ্গে গাঁথা ভাজা ইলিশের টুকরা। ফালি ফালি করে কাটা পনির। ডিম ভাজা। ভাজা রূপচান্দা শুঁটকি। একপাশে গরম করা গতরাতের বাসি ভাত। আরেকটা বাটিতে দেখলাম খুদভাত। রাজ্জাক স্যার বাসি ভাতের প্লেট থেকে চামচ দিয়ে ভাত তুলে নিলেন। তারপর ভাতের সঙ্গে কিছু তাজা মুড়ি মাখিয়ে নিলেন। সেদিনই প্রথম জানতে পারি, ঢাকা জেলার কেরানিগঞ্জ এলাকার মানুষ ভাতের সঙ্গে মুড়ি মাখিয়ে তৃপ্তিসহকারে ভোজন করে থাকে। রাজ্জাক স্যার বাসি ভাতের সঙ্গে শুঁটকি ভাজা দিয়ে শুরু করলেন। ছোটোদের আকর্ষণ দেখলাম খুদভাতের দিকে। আমাদের চট্টগ্রামেও মানুষ খুদভাত খেয়ে থাকে। তবে যারা খায় তারা অত্যন্ত গরিব, চাল কেনার ক্ষমতা যাদের নেই। প্রথম দিনেই আমি অনুভব করলাম, রাজ্জাক স্যারের বাড়িতে খাওয়াটা একটা রীতিমতো পারিবারিক উৎসব। আর খাদ্যবস্তু শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে।
সকালের নাস্তার পর রাজ্জাক স্যার তামাক টানতে টানতে বললেন, এখন আপনের কিছু কথাবার্তা কন।
আমি আমার গবেষণার কথাটি তুললাম। তিনি আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আপনে তো লেখালেখি করেন।
আমি বললাম, এ পর্যন্ত আমার চারটি বই বেরিয়েছে।
তিনি বললেন, পরের বার আওনের সময় লইয়া আয়েন। দেখি কী লিখেন।
তার পরের দিনই আমার লেখা চারটি বইয়ের কপি নিয়ে হাজির হলাম। তিনি বললেন, আমি ত এখন বাজারে যাইবার লাগছি। শেলফের একটা কোণা দেখিয়ে বললেন, ওইহানে রাইখ্যা যান। কাইল আবার আয়েন। একটু দেরি কইরা আইবেন। বাজার থেইক্যা আওনের পর অইলে ভালা। কিছুক্ষণ কথাবার্তা কওন যাইব।
তার পরদিন গিয়ে দেখি সবে তিনি বাজার থেকে ফিরে এসেছেন। দুটি বিরাট ঝুড়িভরতি বাজারের সওদা। মাছ, মাংস, তরিতরকারি একে একে ভ্রাতৃবধুর হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে একটু হাসলেন এবং জিগ্গেস করলেন, মৌলবি আহমদ ছফা, আপনে কখনো মৌলবিবাজার গেছেন?
আমি বললাম, গিয়েছি।
তিনি ফের জানতে চাইলেন, কখনো কাঁচাবাজারে গেছেন?
আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে জাননের লাইগ্যা। আমি একবার তুরস্কের বইয়ের দোকানে যাইয়া দেখলাম, বামপন্থী বই আর ধর্মীয় বইপত্র সব দোকানে সাজাইয়া রাখছে। বইয়ের দোকান পরখ করলেই বেবাক সমাজটা কোনদিকে যাইতাছে, হেইডা টের পাওন যায়। আরেকবার কায়রো গিয়া দেখলাম, নীলনদের পাড়ে মজুরশ্রেণীর মানুষেরা বড় বড় গামলা ভরতি কইর্যা বরবরটি ভেজিট্যাবল আরাম কইরা খাইতাছে। মোটাসোটা মানুষ। খাওনের পরিমাণটাও তেমন। কী খায়, কী পড়ে এই দুইডা জিনিস না জানলে একটা জাতির কোনো কিছু জানন যায় না।
তিনি বাজার থেকে সবে এসেছেন, এখনও পায়ে প্যাঁক কাদা লেগে রয়েছে। পরনের লুঙ্গিটায়ও কাদার ছিঁটে লেগেছে। তিনি বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা আপনে একটু বয়েন। আমার সারা গা কুটকুট করতাছে। একটু ধুইয়া আহি। বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে খদ্দরের সাদা পাজামা এবং খয়েরি পাঞ্জাবি পরলেন। শরীরটা ভালো করে মোছা হয়নি বলে গোছা দাড়ি থেকে দুএক ফোটা পানি ঝরে পড়ছে। চাদর দিয়ে মুছে নিয়ে গুড়গুড়িতে টান দিয়ে বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা, ওই যে আপনের বই। তিনি বড় টেবিলটা দেখিয়ে দিলেন। আমি আমার চারটি বই দেখতে পেলাম। তিনি ধোয়া ছেড়ে বললেন, একটা কথা মনে রাখন খুব জরুরি। এই যে হবস তার লেভিয়াথান বইতে তিনটা শব্দ ‘ন্যাস্টি’, ‘ব্রুটিস’ এবং ‘শর্ট’ যেভাবে যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, তার বদলে বেবাক ডিকশনারি খুঁইজ্যাও আপনে কোনো শব্দ পাইবেন না। যখন গদ্য লিখবেন এই কথাটি সবসময় মনে রাইখেন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, আমার বইতে যে দীর্ঘ আবেগসর্বস্ব বাক্য আমি লিখেছি, সেদিকে তিনি ইঙ্গিত করছেন। আমি ভীষণ শরমিন্দা হয়ে পড়লাম।
ছোটো যে বাচ্চাটা তামাক সেজে দিতো, চা এনে দিতো, নামটি এখন ভুলে গেছি। বাচ্চাটিকে ডেকে বললেন, এই দুই পেয়ালা চা দিয়া যা। তিনি এক কাপ নিজে নিলেন এবং আরেক কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মৌলবি আহমদ ছফা চা খান। চুমুক দিতে দিতে বললেন, সবসময় লেবু দিয়া চা খাইবেন, চায়ে যে দোষ আছে বেবাক এক্কেরে কাইট্যা যাইব। আমি ত সারাদিন চা খাইয়া টিক্যা আছি। চা শেষ করার পর বললেন, আপনে জসীমুদ্দীনের লেখাটেখা পড়েন। জসীমুদ্দীন শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ে ‘স’টা ‘ছ’ এর মতো উচ্চারণ করতেন। আমি জবাব দিলাম, এক সময়ে জসীমুদ্দীন সাহেবের লেখা পড়তাম। এখন আর কোনো আগ্রহ বোধ করিনে।
রাজ্জাক স্যার বললেন, আমি জসীমুদ্দীনের লেখা খুব পছন্দ করি। আপনি কি তাঁর আত্মজীবনী পড়েছেন?
আমি বললাম, ‘জীবন কথা’র কথা বলছেন স্যার? পড়েছি।
গদ্যটি কেমন?
খুব সুন্দর।
রাজ্জাক সাহেব বললেন, এরকম রচনা সচরাচর দেখা যায় না। তারপর তিনি হুঁকো টানতে টানতে জসীমুদ্দীনের গল্প বলতে আরম্ভ করলেন। একসময় কলকাতায় আমি এবং জসীমুদ্দীন এক বাড়িতে থাকতাম। একদিন জসীমুদ্দীন আমাকে কাপড়াচোপড় পইর্যা তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইবার তাগাদা দিতে লাগলেন। আমি জিগাইলাম, কই যাইবার চান। জসীমুদ্দীন কইলেন, এক জায়গায় যাওন লাগব। কাপড়াচোপড় পইরা তার লগে হাইট্যা হাইট্যা যখন এ্যাসপ্ল্যানেডে আইলাম, জসীমুদ্দীন ঘাড় চুলকাইয়া কইলেন, কও দেখি এখন কই যাওন যায়? এইরকম কাণ্ড অনেকবার অইছে। একটুখানি হাসলেন।
কবি জসীমুদ্দীনের প্রসঙ্গ ধরে কবি মোহিতলালের কথা উঠলো। মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতিটি বরদাশত করতে পারতেন না। কবি জসীমুদ্দীনের একটি কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধান খেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা। একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইর্যা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনরে এত ঠাট্টা করেন ক্যান। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন। এরপরে রাজ্জাক সাহেব একটি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। দ্যাহেন বাংলাদেশ সরকার জসীমুদ্দীনরে কিছু করল না। আমারে আর জয়নুল আবেদিন সাহেবরে মুশকিলে ফেলাইয়া দিছে। আমগো দুইজনেরে ন্যাশনাল প্রফেসর বানাইছে, আর জসীমুদ্দীনরে কিছু বানায় নাই।
আলোচনার একটা পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামে এসে ঠেকলো। তিনি কীভাবে নজরুলের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন, সেই কাহিনী বয়ান করলেন। রাজ্জাক স্যার যা বলছিলেন তার সবটুকু আমি ভুলে বসে আছি। শুধু এটুকু মনে আছে, নজরুলকে ঢাকার জলসায় তিনি গান গাইতে দেখেছেন। এটাও জানালেন, নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল তনয় দীলিপ রায়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ভাব ছিলো। রাজ্জাক সাহেব জানালেন, কলকাতায় তারা যেখানে থাকতেন, সে জায়গাটা কাননবালার বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল। কাননের বাড়িতে নজরুল ইসলাম পড়ে থাকতেন। উস্তাদ জমীরুদ্দিন এবং কাজী নজরুল ইসলাম মিলে সুরের নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। কোথাও আড্ডায় মজে গেলে নজরুল ইসলামের দিন রাত খেয়াল থাকতো না। মাঝে মাঝে নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী এসে কাননের বাড়ি থেকে নজরুলকে ধরে নিয়ে যেতেন।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ উঠলে রাজ্জার স্যার শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন। নজরুলের জন্য তার প্রাণে এক গভীর ভালোবাসা সঞ্চিত ছিলো। তিনি প্রায়ই বলতেন, বৈষ্ণব কবিদের পর কোনো গীতিকারই নজরুলের মতো জনচিত্তে অমন আসন লাভ করতে পারেনি। তিনি প্রেমেন মিত্তিরের একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করলেন, বজ্র, বিদ্যুৎ আর ফুল এই তিনে নজরুল।
রাজ্জাক স্যারের কথা শুনতে শুনতে অনেক বেলা হয়ে গেলো। এরই মধ্যে ক’জন প্রবীণ ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এদের কাউকে আমি চিনি না। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তিনি বিলেতের গল্প করতে আরম্ভ করলেন। বিলেতের কথা উঠতেই খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলো, রাজ্জাক স্যার বললেন, ইহুদিদের মাংসের দোকানের বেশির ভাগ ক্রেতা মুসলমান। ইহুদিরাও মুসলমানের মতো আড়াই পোঁচ দিয়া পশু জবাই করে। তার নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বললেন, আমি জবাই করা গোশতের খোঁজ করবার লাগছিলাম, এক ইহুদি কসাইর দোকানে যাইয়া হাজির অইলাম। আমারে এক নজর দেইখ্যাই হে কইয়া বসলো, আপনে কি খুঁজতাছেন আমি টের পাইছি। আয়েন জবাই করা মাংস নিয়া যান। তারপর থেইক্যা হের কাছ থেকে গোশত কিনা শুরু করলাম। এই প্রবীণ ভদ্রলোকেরা যখন বিদায় হলেন বেলা প্রায় একটা বাজে। রাজ্জার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা, দুপুরের খাবারটাও খাইয়া যান।