সাত

কিছুকাল আগে প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল হক ‘পূর্ববাংলা আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক? এই শিরোনামে একটি নাতিক্ষুদ্র পুস্তিকা লিখেছিলেন। পুরো ষাটের দশক, এমনকী সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই পুস্তিকাটি বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের কিছুটা প্রভাবিত করেছিল। কমরেড আবদুল হক চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মাও সে তুং, চীনাসমাজের যে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটি দাড় করিয়েছিলেন সেই লাইন অনুসরণ করে এই ব্যাখ্যাটি দাড় করিয়েছিলেন। র্যাডিক্যাল অর্থনীতিবিদ বলে খ্যাত ড. আবু মাহমুদের মতো মানুষও আবদুল হকের ব্যাখ্যাটি সঠিক প্রমাণিত করে একাধিক রচনা প্রকাশ করেছেন। আমার কাছে এই ব্যাখ্যাগুলো হেঁয়ালির মতো মনে হচ্ছিলো। অন্যদিকে মানবেন্দ্রনাথ রায় ‘ইন্ডিয়া ইন টানজিশন’ গ্রন্থে যে পদ্ধতিতে ভারতীয় সমাজের ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছিলেন সেটা আমার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আমি সামান্য মানুষ। এই সমস্ত বিষয়ে কোনো মতামত প্ৰদান করা কিংবা মতামত সত্যি বলে মেনে নেয়া কোনোটাই সম্ভব ছিল না।

একদিন বিকেলবেলা রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে বিষয়টি উত্থাপন করলাম। বললাম, স্যার, বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কোথায়? এটা আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ একথা কি সত্যি?

স্যার বললেন, আপনে একটু বয়েন। তিনি বাথরুমে গেলেন। এসে গামছা দিয়ে দুপায়ের পানি মুছে যুত হয়ে বসলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশলেন। তারপর বললেন, ইন দ্যা স্ট্রিকটেষ্ট সেন্স অভ দ্যা টার্ম ইন্ডিয়াতে কোনো ফিউডালিজম আছিল না। বেঙ্গলের কথা ত এক্কেরে আলাদা। বেঙ্গলের কথায় পরে আইতাছি। তার আগে রেষ্ট অভ দি ইন্ডিয়ার খবর লই। ফিউডালিজম অইল একটা ক্লোজড সিস্টেম। বংশপরম্পরা একটা পরিবার স্থায়ী অইয়া একটা জায়গায় বাস করব। তার ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার সব আলাদা। এক জায়গার মানুষ অন্য জায়গায় যাইবার পারব না। কাঁঠালের যেমন কোয়া ফিউডাল সিস্টেমে সামন্তের জমির সঙ্গে সকলের তেমন সম্পর্ক। সামান্তরা অইল নিজের জমিদারিতে সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের মালিক। রাজসভায়

পারলে এক্কোরে সাত খুন মাফ। ইন্ডিয়াতে মোগল আমলের কথা ধরেন, জমিদারি এখানে বংশানুক্রমিক আছিল না। সম্রাট ইচ্ছা করলে জমিদারের পোলারে জমিদার নাও বানাইতে পারতেন। আর যদি বেঙ্গলের কথায় আইয়েন, তাইলে এক্কেরে অন্য কথা বলতে অয়। পুরানা বাংলা পুঁথিতে দেখা যায় বাংলার বাণিজ্যবহর জাভা সুমাত্রা এইসকল অঞ্চলে যাওয়া-আসা করছে। যেখানে বাণিজ্য এইরকম সচল থাকে। সেই সমাজটারে অন্য যা ইচ্ছা কাইবার চান কন, কিন্তু ফিউডালিজম বলবার পারবেন না। ভিটফোগোলের হাইড্রোলিক থিয়োরি বেঙ্গলের বেলায় এক্কেরে খাটে না।

আমি বললাম, তা হলে বেঙ্গলের সমাজের নেচারটা কী?

স্যার বললেন, যা ইচ্ছা কন, কিন্তু ফিউডালিজম কেইবার পারবেন না। ইন্ডিয়ার অন্যান্য প্রোভিন্সে যেটুকু ফিউডালিজমের চিহ্ন খুঁইজ্যা পাওন যায়, বেঙ্গলে তার ছিটাফোটাও পাইবেন না। গ্রামগুলার ফরমেশন দেখলেই বুঝতে পারবেন। এইখান থেইক্যা বিহারে যান, দেখবেন সীন এক্কোরে পালটাইয়া গেছে। ফিউড়ালের অবস্থানের চাইর পাশে গোটা গ্রামবাসীর বসবাস। বেঙ্গলে সেইসব আপনে পাইবেন না। আপনে কি মনসামঙ্গলের চাদ সওদাগরের কাহিনী পড়ছেন?

আমি বললাম, একসময় বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম, সেই সুবাদে বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়েছে।

তা অইলে চাদ সওদাগরের কাহিনী আপনের জানা। বেবাক বাংলা সাহিত্যে এইরকম শিরদাঁড়ার মানুষ একটাও দেখছেন? আমি বললাম, না, চাদ সওদাগরের মতো শক্তিশালী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে একেবারে বিরল। মাইকেলের মেঘনাদকেও চাদ সওদাগরের পাশে স্নান দেখায়।

স্যার বললেন, চাঁদ সওদাগর চরিত্রের এই যে ঋজুতা এইডা আইল সমুদ্র-বাণিজ্যশক্তির প্রতীক।

আমি আমার মূল প্রশ্নে ফিরে গেলাম, উনারা যে বলছেন, পূর্ববাংল আধা-সামন্তবাদী আধা-উপনিবেশবাদী।

স্যার ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, ওরা যদি গায়ের জোরে কইবার চায় আপনে কী করবেন, মারামারি করবেন নিহি?

কিছুদিন পর এক সকালে গিয়ে দেখি নিয়াজ মোর্শেদ বসে আছে। তার সঙ্গে স্যার ড. কাজী মোতাহের হোসেনের গল্প বলছেন। কাজী কোথায় গিয়ে কী কারণে জানি আটকা পড়ে গিয়েছিলেন, দেশে ফেরার পথে তিনি ক্লাবে এসে রাজ্জাক স্যারের খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু নামটা ভুলে গেছেন। স্যার ঘটনাটা এইভাবে বললেন, আপনেরা ছেলেটারে দেখছেননি? সকলে জানতে চাইলেন, স্যার, আপনি কোন ছেলেটার খোঁজ করছেন? মোতাহের সাহেব বললেন, সেই ছেলেটা কী যেন নাম। নাকি দাড়িটাড়ি রাইখ্যা বেশ কাপ্তেন আইছে। কে একজন বললেন, স্যার, আপনি কি রাজ্জাক সাহেবের কথা বলছেন? হ্যা হ্যাঁ, তার নাম আবদুর রাজ্জাক। এতক্ষণে মনে পড়ছে। একথা বলে স্যার খুব করে হাসলেন। তারপর রাজ্জাক স্যার কাজী মোতাহের হোসেন সাহেবের আরেকটা গল্প বললেন। রাজ্জাক স্যার তখন ছাত্র। মোতাহের হোসেন সাহেব স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্টে ডেমোনেস্ট্রেটর না লেকচারার। তিনি দাবাখেলার পার্টনার খুঁজে বেড়াতেন। সবসময় কিন্তু পার্টনার পাওয়া যাইত না। বাধ্য অইয়া কাজী সাহেবকে কলতাবাজার যাইতে অইত। কশাইগো মধ্যে দুয়েক জন ভালো প্লেয়ার আছিল। কাজী সাহেব তাগো লগে বইয়া যাইতেন। একবার খেলতে বাইলে দিন রাইতের খবর থাকত না। একবার অইল কী, আমি উনার ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিতে গেলাম। উনি ফ্রি আছেন কি না দেখতে। দেখলাম তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে ছাত্রদের অংক বুঝাইতেছেন, আমারে দেহামাত্রই বাইরে আইস্যা মৃদুস্বরে কইলেন, তুমি একটু পরে আইয়ো। এই ক্লাসটার পরে তোমার সঙ্গে বসা যাইব। কিছুক্ষণ পর আমি যখন গেলাম ততক্ষণে ক্লাস শেষ অইয়া গেছে। তিনি সাইকেলসহ আমারে সঙ্গে কইরা সেগুনবাগিচার বাড়িতে গেলেন। সাইকেলটা হেলাইয়া রাইখ্যা দাবার বোর্ড লইয়া বাইলেন। দুই দান খেলা শেষ অইছে। আমি কইলাম, বেলা পাঁচটার পরে আমার চাইল্যা যাওন লাগব। পাঁচটার পর কারফিউ। তখন ওআর টাইম। কাজী সাহেব কইলেন যখন যাইবা তখন ত যাইবা। অখন বোর্ড সাজাও। বাধ্য আইয়া খেলতে লাগলাম। রাইত নটার সময় খেলা শেষ কইর‍্যা কইলেন, এখন তুমি কেমনে যাইবা? আমি কইলাম, কারফিউর মধ্যে আমি কেমনে যামু? উনি কইলেন, হেইডা একটা কথা। তুমি এখন কী করবা, এইহানে শুইয়া থাকতে পারবা? লজ্জায় কইলাম, ঠিক আছে শুইয়া থাকুমনে। কাজী সাহেব তা উপরে উইঠা গেলেন। আমি ঘুমাইতে চেষ্টা করলাম। কিছুতেই ঘুম আসে না। একে ত পেটে দানাপানি কিছু পড়ে নাই, তারপর এত বড় বড় বাদুরের মতো মশা। সারা শরীর এক্কেরে রক্তাক্ত কইর‍্যা ফেলাইছে। এর মধ্যেও চোখ বন্ধ কইর‍্যা পইড়া রাইছি। আধা রাইত পরে উপর থেইক্যা নাইম্যা কাজী সাহেব আমারে ডাকতে আরম্ভ করল, আবদুর রাজ্জাক, এ্যাই আবদুর রাজ্জাক, তুমি ঘুমাইয়া পড়ছ নিহি। আমি উইঠা কইলাম, না স্যার, আমি জগন্নাই আছি। তোমার একটু উপরে আওন লাগে। আমি অবাক অইয়া কইলাম, কেন স্যার? তোমারে উপরে ডাকতে আছে।

আসল ঘটনাটি এরকম। রাজ্জাক স্যার আওয়াজ করে মশা মারছিল, এবং খুব কাশছিলেন। কাশির শব্দ শুনে বেগম সাহেবার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি কাজী সাহেবকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন, নিচে কে একটা কাশছে, দেখে এসো। কাজী সাহেব বললেন, দেখে আসার দরকার নেই। ওটা আবদুর রাজ্জাক। দাবা খেলতে এসে আটকা পড়ে গেছে। পাঁচটার পর কারফিউ। যেতে পারেনি। বেগম সাহেব জানতে চাইলেন, একটা মানুষ নিচে রেখে এসেছেন, তার ভাতপানি কিছুর দরকার আছে একথা আপনার মনে ছিলো না। কাজী সাহেব জানালেন, না, সে কথা আমার বিলকুল মনে আসেনি। বেগম সাহেব চটে গিয়ে বললেন, যান এখুনি উপরে ডেকে নিয়ে আসেন। বেগম সাহেবের ধাতানি খেয়ে রাজ্জাক সাহেবকে ওপরে ডাকতে এসেছেন।

মাঝখানে স্যার একবার সপরিবারে ভারতে গিয়েছিলেন। আমি যখন শুনলাম তারা কাশীর যাবেন, হঠাৎ ইচ্ছা জাগলো স্যারকে আমার জন্য একটা শাল আনতে বলি। বললামও। স্যার বললেন, আর কোনো জিনিস আপনের দরকার নিহি? আমি বললাম, যদি আপনি বইয়ের দোকানে যাওয়ার সুযোগ পান ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের একটা নির্ভরযোগ্য ইতিহাস আনবেন আমার জন্য। আমি ধরে নিয়েছিলাম স্যার ভুলে যাবেন। প্রায় আড়াই সপ্তাহ পরে ক্লাবের সামনে স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার ফিরে এসেছেন। আমি কোনো সংবাদ পাইনি। আমি অবাক হয়ে বললাম, স্যার কখন ফিরলেন?

বললেন, আজ বেয়ানের ফ্লাইটে। মৌলবি আহমদ ছফা আপনে কেমন ছিলেন?

আমি বললাম, ভালো স্যার।

কাইল বেয়ানে আপনে একবার আয়েন।

পরদিন সকালবেলা আমি স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন, চলেন নাস্তা খাই। নাস্তা খাওয়ার পর স্যার আমার হাতে সত্যি সত্যি ঘিয়ে রঙের একটা কাশ্মিরী শাল তুলে দিলেন। আমি কী যে খুশি হয়েছিলাম! আমি স্যারকে দেখাবার জন্য চাদরটা গাটে জড়িয়ে নিচ্চিলাম, নিচের সিঁড়িতে দুজন শিক্ষকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। স্যার তাদের কণ্ঠস্বর শুনেই বললেন, চাদরটা ওইদিকে থুইয়া দ্যান। আমি স্যারের কথা বুঝতে পারিনি। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে আমার গা থেকে চাদরটা টেনে নিয়ে বিছানার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। স্যারের এই আচরণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার বেয়াদবিটা কোথায় হয়েছে। আমার ইচ্ছা হচ্ছিলো একদৌড়ে পালিয়ে আসি। স্যার বোধহয় আমার মনোভাবটা বুঝে ফেললেন, মৌলবি আহমদ ছফা যায়েন না, আপনের লগে একটু কথা আছে।

স্যার এই দুই শিক্ষক ভদ্রলোকের সঙ্গে পূর্ণিমাচাদের গল্প করতে আরম্ভ করলেন। কথা আর ফুরোয় না। আমি বসে বসে উসখুস করছিলাম। অবশেষে তারা বিদায় হলেন। স্যার বিছানা থেকে শালখানা কুড়িয়ে নিয়ে আমার কাধের ওপর রেখে দিয়ে বললেন, কিছু জিনিস কাউরে অন্য মাইনষের সামনে দিলে মনে কষ্ট পাইতে পারে। তারপর তিনি কলকাতা থেকে আনা বইয়ের পুঁটুলিটা খুলে আমার হাতে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচাৰ্য না বসু (মনে নেই, পদবিটা কী) লিখিত দ্যা হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক বইটি আমার হাতে দিলেন। আমার ভাবতে খুবই আফসোস হয়, স্যারের দেয়া দুটি উপহারের কোনোটাই আমি সংরক্ষণ করতে পারিনি। একবার খাটের ওপর অ্যাশট্রেতে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে আমি ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের বাইরে গিয়েছিলাম। পাখাটি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। রাত বারোটার সময় বাইরে থেকে এসে দেখি ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে। ফ্যানের বাতাসে অ্যাশট্রে থেকে সিগারেটের আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে। চাদরটাও গেছে। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের হিস্ট্রিটা এক ভদ্রলোককে ধার দিয়েছিলাম। বইটা ফেরত আনা যাতে অসম্ভব হয় সেজন্য ভদ্রলোক কায়দা করে ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন।

কয়েকদিন পরে সকালবেলা স্যারের বাড়িতে গিয়ে দেখি পরিবারের সকলে নাস্তার টেবিলে এসে বসেছেন। সকলে ঈষৎ উত্তেজিত। লক্ষ করলাম সেটা স্যারকেও একটুখানি স্পর্শ করেছে। গতোরাতে শিল্পী কামরুল হাসান টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শিল্পী জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে কী একটা মন্তব্য করেছেন, যা স্যারের পরিবারের প্রায় সকলের কাছেই নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছে। এ নিয়ে সকলে কথা-বলাবলি করছিলেন। স্যার কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেন। নাস্তা খাওয়ার পর স্যার যখন তার ঘরে এলেন, আমি জিগ্‌গেস করলাম, স্যার, আপনি কি মনে করেন জয়নুল আবেদীন খুব বড় শিল্পী?

তিনি সরাসরি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটি গল্পের অবতারণা করলেন। একসময়ে এক ইংরেজ ভদ্রলোক, পেশায় যিনি বিলেতের কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষ উপলক্ষে ঢাকা এসেছিলেন। স্যার বললেন, সেই সায়েবরে আমি ঢাকা শহর ঘুরাইয়া দেখাইতে আছিলাম। শহর দেখানোর কাজ যখন শেষ, আমি কইলাম, চলেন আপনেরে একজন শিল্পীর কাছে লইয়া যাই। উনি কইলেন, আই উড লাভ টু। তারপর সায়েবরে লইয়া শান্তিনগরে আবেদীন সাহেবের বাড়ি গেলাম। আবেদীন সাহেব হবায় দুইখানা ওয়াটার কালার আঁইক্যা শেষ করছেন। এই ওয়াটার কালার দেইখ্যা ত সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া। আমার কানের কাছে মুখ আইন্যা কইলেন, এই ছবিগুলার দাম কত অইব আপনে ধারণা করতে পারেন? আমি জিগাইলাম, আপনি কি ছবি কিনবার চান? সায়েব কইল, আমি একজন গরিব মাস্টার। এইরকম অপূর্ব ছবি কিনার টাহা আমি কই পামু? তারপর আমি আবেদীনের লগে কথা কইলাম। তিনি একেকটা ছবির জন্য মাত্র তিনশ টাহা দাম চাইলেন। লগে লগে মানিব্যাগ খুইল্যা ছয়শ টাহা দিলেন সায়েব। ছবি দুইটা যখন বগলের তলায় লইয়া ফির‍্যা আইবার লাগছিল, তারে খুব খুশি দেখাইতে আছিল। আমারে কইল এক তাল সোনা কুড়াইয়া পাইলেও আমি এত খুশি আইতাম না।

গল্পটা শেষ করার পর আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন এবং বললেন, আপনেরা ত এখন নানারকম ছবি দেখেন। জয়নুল আবেদীন ছবিতে যেভাবে স্পেসের ব্যবহার করেন, এরকম কাউরে করতে দেখছেন? পাল্কির ছবিটা দেখবেন, বেহারাগুলার মাঝখানে যে ফাঁক সেইটা ভালো কইর‍্যা তাকাইবেন। বেহারাদের পরস্পরের মধ্যে যে দূরত্ব সেইটা এইদিক ওইদিক একটু বেশিকম অইলেই কিন্তু ছবিটার আবেদন কইম্যা যায়।

সাহেব অধ্যাপকের কথা যখন উঠলো, আমি সাহস করে জিগ্‌গেস করলাম, স্যার, আপনার সঙ্গে কি করে ডিক উইলসন সাহেবের পরিচয় হলো? আপনি কি তাকে বিলেত থেকেই চিনতেন?

রাজ্জাক স্যার মাথা নাড়লেন, উনার সঙ্গে আমার ঢাকাতেই পরিচয়। তিনি ল-এর মানুষ। কথাবার্তা শুইন্যা মনে অইল বেশ লেহাপড়া জানে। জিগাইলাম, এইখানে আমাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করবার চান নিহি। উইলসন সায়েব কইলেন, আমি চাইলেই কি মাস্টারি করতে পারি? আমাকে চাকরি দেয় কে? আমি লগে লগে ভাইস চ্যান্সেলর মুয়াজ্জেম সায়েবের সঙ্গে দেখা কইর‍্যা কইলাম হিয়ার ইজ অ্যান আউটস্ট্যান্ডিং পারসন, তারে চাকরি দিলে ইউনিভার্সিটি উইল বি বেনিফিটেড। মোয়াজ্জেম সাব তার চাকুরি দিতে রাজি অইলেন। আমি কইলাম, আপনে অখনই দরখাস্ত করেন। দরখাস্ত করলেন। বাস চাকুরি অইয়া গেল। ছ’মাসের বেশি আছিলেন না। আমি উইলসন সাবরে এশিয়া অঞ্চলের প্রতি দৃষ্টি দেওনের জন্য ইনস্পায়ার করছিলাম। তিনি এই অঞ্চলে বিস্তর ঘোরাঘুরি করছেন। বইটা পড়লেই টের পাইবেন। স্যার বললেন, আরও একজন ইন্টারন্যাশনালি ফেমাস মানুষ আমাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন মাষ্টারি করেছিলেন, সেই ভদ্রলোক ইংরেজ নন, ফ্রেন্স।

আমি জানতে চাইলাম, স্যার আপনি নিশ্চয়ই তাঁর নাম মনে রেখেছেন?

স্যার তার দাড়ির গোছোটাতে হাত বুলিয়ে বললেন, নাম মনে থাকব না ক্যান? তাঁর নাম ক্লদ লেভি স্ট্রস।

একদিন সকালবেলা স্যার তাঁর ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করছিলেন, আমরা যখন ছোড়া আছিলাম, হেই সময়ে গাঁও গোরামে উচা লম্বা একধরনের শালপ্রাংশু চেহারার মানুষের দেখা পাওন যাইত, এখন পাঁচ গ্রাম বিচরাইলেও সেইরকম বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ পাওন যায় না। আমি জিগ্‌গেস করলাম, কারণ কী?

স্যার হুঁকোর নলটা ঠোঁটের কাছে ধরে কী একটা চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, পুষ্টিকর খাবারের দুষ্প্রাপ্যতাই মানুষের স্বাস্থ্যহানির আসল কারণ। আগে গ্রামে অঢেল খাদ্যদ্রব্য পাওন যাইত। অখন যায় না। নদীনালা বিলে হাত দিলেই মাছ পাওন যাইত। এখন একরকম অদৃশ্য অইয়া গেছে। মাইনষে খাইব কী। আগের নদীও কি এখন আছে! পূর্বের দিনে ঢাহা শহর থেইক্যা আমাগো গ্রামে যাইতে অইলে তিন জাগায় নদী পার আওন লাগত। এইবার যাইয়া নদীর দেখাও পাইলাম না। বেবাক খটখট্যা শুকনা। নদী কই সাইর‍্যা গেছে। তারপর রাজ্জাক স্যার তাঁর ছেলেবেলার এক মধুর স্মৃতির কথা উল্লেখ করলেন। আমাগো ছোড়বেলায় বাড়ির পেছনে একটা লম্বা বরই গাছ আছিল। শীতকালে টিনের চালের থেইক্যা নিচে মাটিত টুপটুপ কইর‍্যা শিশিরের ফোটা ঝইর‍্যা পড়ত। সারারাত গাছ থেইক্যা পাকনা বরই পয়লা চালের ওপর, তারপর মাটিতে আইস্যা পড়ত। আমরা আধা ঘুমের মধ্যেও টের পাইতাম, বরই পড়তাছে।

আমি বললাম, বেঠোফেনের মুন লাইট সোনাটায় এইরকম ব্যাপার আছে। শুনলে মনে হবে আপনি টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দ শুনছেন।

স্যার হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনে কি আবদুল করিম খান সাহেবের গান শুনছেন? আমি বললাম, একটা মাত্র লং প্লেয়িং রেকর্ড ঢাকায় পাওয়া যায়। সেটি শুনেছি।

স্যার আমার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বললেন, করিম খান সাহেবের কণ্ঠে দানাদার মিছরির মতো একটা মিষ্টি স্বাদ আছে। অন্য কোনো গায়কের কণ্ঠে সেই জিনিস আপনে পাইবেন না। গান-বাজনার কথা যখন উঠলোই, আমি চাইছিলাম স্যার এ বিষয়ে আরও কিছু কথাবার্তা বলুন। তিনি বলে যেতে থাকলেন, মেগাফোন না হিজ মাস্টার্স ভয়েস মনে নাই, একসময়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের এক বা একাধিক বেহালার রেকর্ড বাইর করছিল। সেইসব জিনিস এখন আর পাওনা যায় না। আমি জানতে চাইলাম। আর কার কার গান বাজনা আপনার ভালো লাগে। স্যার একটু হাসলেন। আমাগো সময় আর আপনেগো সময়ের টেষ্ট এক না। অনেক কিছু পালটাইয়া গেছে। আমি গিরিজা দেবীর গান খুব পছন্দ করতাম, ফৈয়াজ খ্যা সায়েবের গান খুব ভালো লাগত।

স্যারের কাছ থেকে গীবনের ডে ক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্যা রোমান এম্পায়ার বইটি আমি ধারা এনেছিলাম। শেষ করার পর বইটি যখন ফেরত দিতে গেলাম, দেখি স্যার বসে বসে জনসন সাহেবের লাইভস অব দ্যা ইংলিশ পোয়েটস বইটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। আমাকে দেখে বললেন, বিয়েন মৌলবি আহমদ ছফা। আমি জানতে চাইলাম, বইটা কি খুব ভালো?

স্যার বইটি বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওহ্ ভেরি ভেরি ম্যাচ ওয়েল রিটেন। জনসন সাহেব ভীষণ প্রিসাইজ। বাংলা ভাষায় এইরকম একখান বই লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। আমি গীবনের বইটি ফেরত দিলে তিনি বললেন, ডেক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্যা রোমান এম্পায়ার আপনে কি আগাগোড়া পড়ছেন?

আমি বললাম, স্যার একরকম পড়েছি।

স্যার বললেন, একটা জিনিস কি লক্ষ করছেন?

আমি বললাম, কোন জিনিসটা?

স্যার বললেন, গোড়ার দিকে রোমের যেসব মানুষ খ্রিস্টান অইছিল, তারা আছিল মোস্টলি প্লিবিয়ান অ্যান্ড পার্সিকিউটেড। একসময়ে তাগো সংখ্যা যখন বাইড়া গেল এম্পারার জাস্টিনিয়ান রাজ্যরক্ষার প্রয়োজনে নিজেই খ্রিস্টান আইয়া গেলেন। প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান ধৰ্ম আর রোমের খ্রিস্টান ধর্ম এক জিনিস নয়।

রোমের প্যাট্রিসিয়ান খ্রিস্টান এবং প্লিবিয়ান খ্রিস্টানের মধ্যবর্তী সাইকোলজিক্যাল ডিসট্যান্স অনেকদিন পর্যন্ত টিইক্যা আছিল। এই জিনিস আপনে বেঙ্গলের মুসলমানদের মধ্যেও পাইবেন। আশরাফ মুসলমান এবং আতরাফ মুসলমানদের মধ্যে আপনে খুব অল্পই কমন জিনিস খুঁইজ্যা পাইবেন। তবে মুসলমানদের আশরাফ বইন্যা যাইতে বেশি সময় লাগে না। দুধ ঘি ঠিকমতো খাইলেই অ্যারিস্টোক্রেট বইন্যা যায়। যেমন গনি মিয়া মানে আবদুল গনির কথাই ধরেন—না! তার সম্পর্কে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট, —স্যার একজন সাহেবের নাম বললেন, যা আমি মনে রাখতে পারিনি) লেইখ্যা গেছেন গনি মিয়া খুব ভালা হাৰ্মনিয়াম বাজাইতে পারতেন। আর কিছু না। গনি মিয়ার বংশধরেরা ত নতুন অ্যারিস্টোক্রেট হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়া গেছিল। এই গনি মিয়ারে জাতে তোলার লাইগ্যা মওলানা ওবায়দুল্লাহ অনেক কলকাঠি নাড়াইছেন। মওলানা ওবায়দুল্লাহই আছিলেন ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক আর গনি মিয়ার চামচা। আবার এই ওবায়দুল্লাহই আছিলেন আপনেগো নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির … (দাদা না নানা কী বলেছিলেন আমার মনে নেই)। তারা আছিলেন মেদিনীপুরের মানুষ। সোহরাওয়ার্দি টাইটেলটা সেই সময়ে তারা কেউ ব্যবহার করতেন না।

এরই মধ্যে স্যার একবার উঠে বাথরুমে গেলেন। ফিরে এসে গামছা দিয়ে হাত-পা মুছলেন। হুঁকোতে টান দিয়ে আমাকে জিগ্‌গেস করলেন, কী যান কইতে আছিলাম?

আমি মনে করিয়ে দিলাম তিনি ঢাকার গণি মিয়ার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা বলছিলেন। স্যার বললেন, তার ত কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড আছিল না। ঢাকার অ্যারিস্টোক্রেটরা গনিমিয়ার পরিবারের লগে কোনোরকমের বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতেন না। সলিমুল্লাহ মামলায় ঠেকাইয়া এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়া করছিলেন। কিন্তু সলিমুল্লাহরে বেগম সাহেবের বেডরুমে যাওনের সময় পারমিশন লইয়া যাওন লাগত। যেনো নিষিদ্ধ বিষয়ে মন্তব্য করে ফেলেছেন সেজন্য তার চোখেমুখে একটা লজ্জার আভা দেখা গেল।

আমি আলোচনাটাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার জন্য বললাম, স্যার, খোন্দকার ফজলে রাবি দ্যা ওরিজিন অভ দ্যা বেঙ্গলি মুসলমানসার নামে একটি বই লিখেছিলেন এবং সাম্প্রতিককালে বইটির একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। স্যার বললেন, খোন্দকার ফজলে রাব্বি আছিলেন মুর্শিদাবের নওয়াবগো দেওয়ান। একোনমিষ্ট রেহমান সোবহান আছেন না, তার নানা। তথ্যটা আমার জানা ছিল না। আমি স্যারকে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম, খোন্দকার সাহেব লিখেছেন বেঙ্গলের মুসলমানদের বেশিরভাগই বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর। একথা কী করে সত্যি হতে পারে? দেখলাম, ও বিষয়ে স্যারের আলোচনা করার বিশেষ আগ্রহ নেই। স্যার সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়ের শুরু করলেন। সংস্কৃতির আরবি প্রতিশব্দ তমদ্দুন। তমদ্দুন শব্দটি এসেছে মদিনা থেকে।

মদিনা শব্দের অর্থ আইল গিয়া শহর। ইসলামের লগে শহরের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে।

আমি স্যারের মতামতটাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। তাই বললাম, এ বিষয়ে আমি বিশেষ জানি না। তথাপি আমার মনে হয় বেঙ্গলের ক্ষেত্রে একথা বোধ করি সত্যি নয়। বেঙ্গলের গ্রামেই মুসলমানের সংখ্যা বেশি।

স্যার বললেন, সেকথা ঠিক, কিন্তু সূচনাটি অইছিল শহরে, গৌড়, পাণ্ডুয়া, সোনার গাঁ, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এর সবকটাই আছিল সীট অব পলিটিক্যাল পাওয়ার।

খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর রোমের প্লিবিয়ান এবং পেট্রিসিয়ানদের নতুন একটা বিভাজন-রেখার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধরনের একটা প্রায় অলঙ্ঘনীয় বিভাজন-রেখা বেঙ্গলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ক্রিয়াশীল রয়েছে। স্যারের এই কথার মধ্যে আমি একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পেয়ে যাই। আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। সেই সময়ে জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট। আবুল ফজল ছিলেন জিয়া সাহেবের শিক্ষা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এবং তাকে আমরা মান্য করতাম। একদিন সকালবেলা দেখতে পেলাম আবুল ফজল সাহেব মাথায় টুপি দিয়ে অপর এক উপদেষ্টা এম এ জি তাওয়াবের সঙ্গে রমনা ময়দানের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানালেন, তাওয়াব সাহেবের সঙ্গে সিরাতের মজলিসে যাবেন। আমি ভীষণ একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। আবুল ফজল সাহেব নাস্তিকতা প্রচার করতেন। ক্ষমতার কাছাকাছি এসে দেখছি তিনিও নবীভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই ঘটনাটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে। রাজ্জাক স্যার রোমের প্লিবিয়ান খ্রিস্টানদের মনন মানসিকতার বিষয়ে যে ইঙ্গিত করেছিলেন, আমার মনে হল, সেই দোলাচল মনোবৃত্তিটা বাঙালি মুসলমানের মনেও কাজ করে যাচ্ছে। মুসলিম রচিত পুঁথিসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বাঙালি মুসলমানের চৈতন্যের একটি দিক আমি উদ্‌ঘাটন করতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। লেখাটি মাসিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই একটা তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আমি বাঙালি মুসলমানদের বেশিরভাগকেই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর বলে মস্ত অপরাধ করেছি, এ অভিযোগ করে নানা পত্রপত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপা হতে থাকে। আমাদের দেশে এক শীর্ষস্থানীয় কবি ছদ্মনামে তিনটি প্রবন্ধ আমাকে গালাগাল করে লেখেন। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে পুরো ছয় মাস ধরে গালমন্দ করে নিবন্ধ লিখতে থাকেন। পরে ওই নিবন্ধগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে সর্বত্র বিলি করতে আরম্ভ করেন। শুক্রবারে জুমার নামাজের পর সমবেত মুসল্লিদের মধ্যে তার পুস্তিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করে জনমতকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। আজাদ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও তার পুস্তিকাটি বিতরণ করেছিলেন। রাজ্জাক স্যারের হাতেও একটা কপি এসেছিল। আমার লেখাটিও স্যারকে দিয়েছিলাম। আমার লেখাটি সম্পর্কে স্যারের মতামত জানার চেষ্টা করিনি। আমার ধারণা ছিল কোনো একটা সময়ে স্যার তার নিজের মতামত আমাকে জানাবেন। সারাদেশে তুমুল বিতর্ক চলছে। বেশিরভাগ মানুষ আমাকে সমর্থন করছেন। যারা বিরোধিতা করছেন, তাদের সংখ্যাও অল্প নয়। সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপার হল, এই লেখাটিকে উপলক্ষ করে যে-কেউ একটা সামাজিক উত্তেজনা জাগিয়ে তুলতে পারে, আর সেরকম মানুষের সংখ্যা অল্প নয়।

একদিন বাড়িতে যেয়ে রাজ্জাক স্যারকে জিগ্‌গেস করলাম, স্যার, আপনি আবুল কালাম আজাদের পুস্তিকাটি কি পড়েছেন?

স্যার বললেন, হ দেখছি, ওর মধ্যে পড়নের কিছু নাই। বেবাকটাই নির্জলা গালাগালি। এর বেশি কিছু করনের ক্ষমতা আবুল কালামের নাই।

আমার নিজের লেখাটির ওপর চোখ বুলোবার সুযোগ কি আপনের হয়েছে?

স্যার বললেন, আপনের লেখাটাও পড়ছি। উনিশ শ তিরিশ সালের দিকে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের বর্তমান ‘হিন্দু মুসলমান সমস্যা’র পর এত প্রভোক্যাটিভ রচনা আমি বাংলা ভাষায় আর পড়ি নাই।

স্যারের মন্তব্য থেকে আমার রচনাটি তাঁর ভালো লেগেছে কি মন্দ লেগেছে কিছুই বুঝতে পারিনি। তখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি আমার পড়া ছিল না। অতি সম্প্রতিকালে লেখাটি পড়েছি। এইরকম সাম্প্রদায়িক রচনা শরৎবাবুও লিখতে পারেন আমার বিশ্বাস করতে অত্যন্ত কষ্ট হয়েছে। আমার লেখাটিকে কী অর্থে শরৎচন্দ্রের রচনার মতো প্রভোক্যাটিভ বলেছেন, অদ্যাবধি জানার চেষ্টা করিনি।