সোহরাব রোস্তম
মূল: মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী
রূপান্তর: মমতাজউদদীন আহমেদ

ইরানের পরাক্রমশালী রাজা ফেরিদুর কনিষ্ঠপুত্র রাজা ইরিজির কন্যা পরীচেহেরের পুত্র শাহ মনুচেহের যখন ইরানের রাজা হলেন তখন তাঁর সৈন্যদলে নামকরা বীর যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন শাম নামে একজন বীর যোদ্ধা। শাম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, কিন্তু তাঁর কোনো পুত্রসন্তান নেই। তাই মনে অনেক দুঃখ। পুত্রের আশায় বীর শাম দেবতার মন্দিরে মাথা ঠুকে মরেন। অবশেষে দেবতার আশীর্বাদে বীর শাম এক পুত্র লাভ করলেন। পুত্রের নাম রাখলেন জাল।

বলিষ্ঠদেহ জাল দেখতে সুন্দর কিন্তু তার মাথার সব চুল ধবধবে সাদা। সাদা রঙের চুলওয়ালা ছেলে অভিশাপ ডেকে আনতে পারে। এইরকম নানা আশঙ্কার কথা শুনে শাম নিজের হাতে নিজের পুত্রকে ফেলে এলেন আলবুরুজ পর্বতে। কিন্তু দেবতারা ছিল শিশু জালের প্রতি দয়াশীল। ঈগল পাখির মতো ঠোঁট এবং সিংহের মতো পা-বিশিষ্ট সি-মোরগ পাখি উড়ে এসে ঠোঁটে ঝুলিয়ে জালকে নিয়ে গেল। জাল পাখির বাসায় বড় হতে লাগল।

পুত্রকে ফেলে এসে বীর শাম পুত্রশোকে কাতর হয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। তিনি আবার দেবতার মন্দিরে ছেলের জন্য মাথা ঠুকতে লাগলেন। সি-মোরগ পাখি জালকে ফেরত দিয়ে গেল এবং যাবার সময় নিজের পাখনা থেকে একটি পালক ছিঁড়ে উপহার দিয়ে বলল-‘বিপদের সময় এ পালকটি আগুনে তাতালেই আমি সাহায্যের জন্য ছুটে আসব’।

বাদশাহ মনুচেহের কিশোর জালকে দেখে খুশি হলেন। জালকে উপহার দিলেন তেজি ঘোড়া এবং শামকে দিলেন জাবুলিস্তানের শাসনভার। ক্রমে ক্রমে জাল অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল। পিতা শাম গেলেন রাজার আদেশে মাজেন্দ্রানের দৈত্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে। যুবক জাল জাবুলিস্তানের শাসনভার পরিচালনা করছে।

একবার যুবক জাল গেলেন কাবুল-রাজা মেহেরাবের রাজ্যে বেড়াতে। রাজা মেহেরাবের সুন্দরী কন্যা রুদাবার সঙ্গে প্রণয় হলো জালের এবং অবশেষে সকলের সম্মতি নিয়ে জাল ও রুদাবার বিবাহ সম্পন্ন হলো।

আনন্দে দিন কাটে নব দম্পতির। কিছুদিনের মধ্যে রুদাবারের হলো কঠিন অসুখ। কত ওষধ, বদ্যি, কিন্তু অসুখ সারে না। জাল তখন সি-মোরগের পালক ধরল আগুনের তাপে। সি-মোরগ উড়ে এসে হাজির হলো। সি-মোরগ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগিণীর রোগ পরীক্ষা করে বলল-ওহে ভাগ্যবান জাল তুমি অতি সত্বর পিতা হতে চলেছ। তোমার পত্নী রুদাবা এমন এক সন্তানের মা হতে চলেছে, যে সন্তানের নাম পৃথিবীতে খ্যাত হবে তার বীরত্ব ও সাহসের গুণে।’

সি- মোরগের কথা মিথ্যা হবার নয়। জাল এক শক্তিমান এবং বলবান পুত্রসন্তান লাভ করলেন। এই ছেলেই মহাবীর রোস্তম। ইরানের জাতীয় ইতিহাসে যার নাম এখনও অক্ষয় অমর হয়ে আছে।

শৈশবেই রোস্তমের মধ্যে বীরত্বের লক্ষণ ফুটে উঠল। সে তেজি ঘোড়ায় চড়ে দুরন্তবেগে ছুটতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে গদা ও গর্জ নিয়ে যুদ্ধে করতে। সামান্য খাদ্যে তার ক্ষুধা মেটে না। এক দাইমায়ের দুধপান করে তার তৃষ্ণা নিবারণ হয় না। সে পাঁচটি ছাগলের মাংসের কাবাব দিয়ে প্রাত:রাশ সম্পন্ন করে।

একদিন রাজার মত্ত হাতি শিকল ছিড়ে রাজপথে ছুটছে। হাতির পায়ের নিচে পড়ে মানুষ জীবন দিচ্ছে কিন্তু সাহস করে কেউ মত্ত হাতির মুখোমুখি হচ্ছে না। কিশোর রোস্তম গদা নিয়ে পাগলা হাতির সামনে ছুটে এল এবং গদার এক আঘাতে হাতিকে ধরাশায়ী করল। বীর রোস্তম অজেয় সোপান্দি দুর্গে কৌশলে প্রবেশ করে দুর্গের সর্দার ও সিপাহিদের হত্যা করে পিতামহের হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে এল। পিতা জাল বীর পুত্র রোস্তমকে আলিঙ্গন করলেন। কেননা তিনি বারবার এ দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে বিফল হয়েছেন। আজ পুত্রের শৌর্যে পিতার বুক গর্বে ফুলে উঠেছে।

তুরানের সেনাপতি আফরাসিয়াব ইরান আক্রমণ করে রাজা নওদরকে হত্যা করলেন এবং জালের রাজা জাবুলিস্তান আক্রমণের জন্য সৈন্য প্রেরণ করলেন। পিতা জালের সঙ্গে পুত্র রোস্তমও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধসাজ পরলেন। আস্তাবলে প্রবেশ করে সবচেয়ে দুরন্ত ও অবাধ্য যে ঘোড়া রখ্‌শ তাকেই নির্বাচন করলেন রোস্তম। রাক্ষস বংশের রখ্‌শ এতদিনে প্রকৃত মনিবকে পেয়ে মহানন্দে হ্রেষাধ্বনি করল। বীর রোস্তম রংধনু রঙের রেশমি পোশাক পরল। মাথায় তাজের ওপর ঝুলাল রেশমের বর্ণাঢ্য রুমাল আর হাতে তুলে নিল পিতামহ শামের সেই বিখ্যাত গদা।

রোস্তম যুদ্ধে চলল, কিন্তু বুকে ও বাহুতে নেই লোহার বর্ম। যে দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। যুদ্ধে তুরাণি সৈন্যদের পিছু হটতে হলো। তরুণ রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে স্বয়ং সেনাপতি আফরাসিয়াব কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালালেন।

বীর রোস্তম হলেন ইরানের মহাবীর রোস্তম। রোস্তম ইরানের স্বাধীনতা উদ্ধার করলেন। রাজা কায়কোবাদ রাজসিংহাসনে বসলেন। জনগণ মহাবীর রোস্তমের জয়গানে ইরান মুখরিত করল। সুখে শান্তিতে ইরানবাসী দিনাতিপাত করতে লাগল।

কিন্তু রাজা কায়কোবাদের পর রাজা কায়কাউস রাজা হলেন। কায়কাউস ছিলেন খেয়ালি এবং চাটুকারিতা-প্রিয় রাজা। চাটুকারদের প্রশংসায় বিভ্রান্ত হয়ে কায়কাউস দৈত্যদের রাজ্য পাহাড়ি দেশ মাজেন্দ্রান জয় করতে ছুটে গেলেন। মাজেন্দ্রানের রাজা প্রতিবেশী বন্ধু মহাবলী সফেদ দৈত্যের সাহায্যে রাজা কায়কাউসের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে রাজা কায়কাউসকে বন্দি করে রাখল।

ইরান রাজার এ বন্দিদশার সংবাদ পৌঁছাল জাবুলিস্তানে। মহাবীর রোস্তম রুখশের পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটলেন দৈত্যরাজ্য মাজেন্দ্রানে। দীর্ঘ পথ, পায়ে পায়ে বিপদ আর ছলনা। অপরিসীম মনোবলের অধিকারী রোস্তম সমস্ত বাধা অতিক্রম করে অবশেষে আলবুরুজ পর্বত ডিঙিয়ে এলেন মাজেন্দ্রানে। রোস্তমের গদার আঘাতে একে একে শত্রু ভূপাতিত হলো। রাজা কায়কাউস মুক্ত হলেন।